নিজস্ব প্রতিবেদক : সারা বিশ্বে মহামারি রূপ নেওয়া করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে প্রায় সব দেশেই জারি করা হয়েছে লকডাউন। এই লকডাউন করার প্রধান কারণ হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা। আর এই কাজটি করতে অর্থাৎ মানুষদের বাড়ির বাইরে বের হওয়া ঠেকাতে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে।
স্বাভাবিক দিনের তুলনায় রাস্তায় মানুষ কম বের হলেও একেবারে থামানো যাচ্ছে না। নানা অজুহাতে তারা বেরিয়ে আসছেন।
এই মানুষগুলোকে বাড়ির ভেতরে রাখতে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানোর পাশাপাশি মোটা অঙ্কের জরিমানাও করেছে পুলিশ। কিন্তু তাতেও খুব একটা পরিবর্তন আসেনি বরং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
এমন অবস্থায় কয়েকটি জেলার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, জেলা প্রশাসন এবং সচেতন মহল সাধারণ মানুষকে ঘরের ভেতরে রাখতে অভিনব কায়দা অবলম্বন করেছেন।
ঘরে থাকবেন? নাকি বাজারের ডিউটি?
কুড়িগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার তাদের ফেসবুক পেজে ঘোষণা দিয়েছেন, কেউ যদি বিনা প্রয়োজনে মোটরসাইকেল নিয়ে বের হয়, তাহলে তাদেরকে আট ঘণ্টা পুলিশের সাথে বাজারে ভিড় নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করতে হবে।
সেই পোস্টে পুলিশ সুপার প্রশ্ন করেন, ঠিক করে নিন? কি করবেন? ঘরে থাকবেন? নাকি বাজারের ডিউটি?
এই ঘোষণার একদিনের মাথায় অর্ধশত তরুণকে তারা শাস্তি হিসেবে ভিড় নিয়ন্ত্রণে কাজে লাগিয়েছেন।
জেলার পুলিশ সুপার মহিদুল ইসলাম বলেন, ‘যে ছেলেরা নিজেরা নিয়ম ভেঙেছে, আমরা যখন তাদেরকেই বলি অন্য মানুষদের সচেতন করতে, তখন তারা অটোমেটিক নিজেদের ভুল অনুধাবন করতে পারে। তারা আর এই ভুল করবে না বলে আমাদের জানিয়েছে।’
স্থানীয় এলাকাবাসীসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বেশিরভাগ মানুষ জেলা পুলিশের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে।
বাইরে বেরোলেই আক্রান্ত রোগীর সেবা করতে হবে
এদিকে সিলেটের ছাতক উপজেলায় পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কাউকে যদি কোন কারণ ছাড়াই কাউকে ঘরের বাইরে পাওয়া যায় তাহলে তাকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সেবা এবং এই রোগে মৃত ব্যক্তির দাফন কাজে নিয়োজিত করা হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. গোলাম কবিরের এই সিদ্ধান্তকেও স্বাগত জানিয়েছে সাধারণ মানুষ।
গতকাল ‘ইউএনও ছাতক’ নামে একটি ফেসবুক পেজে এ সংক্রান্ত পোস্ট দেওয়া হয়। মুহূর্তেই সেটা ভাইরাল হয়ে পড়ে।
এ বিষয়ে গোলাম কবির জানান, সিলেটে এখন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক কম হওয়ায় উপজেলার মানুষরা সেরকম সচেতন না।
গাজীপুর, চট্টগ্রাম, কুমিল্লায় গান গেয়ে প্রচারণা
কার্যত লকডাউনের এই সময় মানুষকে বাড়িতে থাকার আর্জি জানাতে বিভিন্ন জেলায় পুলিশ দলবদ্ধ হয়ে গান গেয়ে গেয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
পুরনো কিছু জনপ্রিয় গানের শব্দ এদিক-ওদিক করে অনেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন আবার অনেক পুলিশ ইউনিট নিজেরাই গান রচনা করে সুর তুলছেন।
যেমন চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার পুলিশ সদস্যদের দেখা যায় থানার সামনে দাঁড়িয়ে গানে গানে করোনাভাইরাসের ব্যাপারে সচেতনতার নানা পরামর্শ দিচ্ছেন।
সাব ইন্সপেক্টর মঞ্জুরুল আলমের কথা ও সুরে উঠে এসেছে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হলে কি করবেন, এ থেকে বাঁচার উপায় কি, কেন বাড়িতে থাকা প্রয়োজনসহ আরও নানা প্রশ্নের উত্তর।
মানুষকে বাড়ির ভেতরে থাকার ব্যাপারে সচেতন করতেই বিনোদন রূপে বিষয়টি উপস্থাপনের কথা জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মাহবুবুর রহমান।
একইভাবে ঢাকার গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার পুলিশ সদস্যরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে রেকর্ডিং করা গানের সঙ্গে গলা মিলিয়ে এবং হাতে তালি দিয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালিয়েছেন, যেন মানুষ বাড়িতেই থাকেন।
গাজীপুরের পুলিশ সুপার শামসুন্নাহারের নেতৃত্বে চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকার মহাসড়কে জেলা পুলিশ ব্যতিক্রমধর্মী এই প্রচারণা চালায়।
এ সময় অতিথি হিসেবে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্য আ. ক.ম মোজাম্মেল হককে।
শুরুতে লিফলেট বিতরণ ও মাইকিং-এর মাধ্যমে প্রত্যাশিত কোন সাড়া না পেয়ে এই ব্যতিক্রমী উপায়ে প্রচারণা চালানোর কথা জানান জেলার পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার।
‘আমরা যখন গান গেয়ে প্রচার করলাম তখন দেখি যে আমরা বেশি মানুষের মনোযোগ নিতে পারছি। এই ভিন্নমাত্রার গান মানুষের মনে গেঁথে গেছে। তারা মাইকিংয়ের চাইতে গানটাকেই বেশি এপ্রিশিয়েট করছে,’ বলেন মিস শামসুন্নাহার।
এ ছাড়া কুমিল্লাতেও গানে গানে সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচারণা চালিয়েছে পুলিশ।
আঞ্চলিক ভাষায় মাইকিং
এ ধরণের সচেতনতামূলক প্রচারণায় মাইকিং খুব প্রচলিত একটি উপায় হলেও কিছুটা ভিন্নতা দেখা গেছে নোয়াখালীতে।
সেখানে এক ব্যক্তিকে করোনাভাইরাস নিয়ে সতর্কতা ও মোকাবিলায় করণীয় বিষয়ে নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় মাইকিং করতে দেখা যায়।
এ নিয়ে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ ভাইরাল হয়েছে।
তার কয়েকটি কথা এরিমধ্যে কৌতূহলের সৃষ্টি করছে। এরমধ্যে কয়েকটি হলো-
‘যেখানে লোকজন বেশি সেখানে আপনে বেশি গফ মাইত্তে ফাইত্তেন্ন। চার দোকানে চা খাইবেন, চলি আসবেন।’
(যেখানে লোকজন বেশি সেখানে গল্প করতে পারবেন না। চায়ের দোকানে গেলে, চা খেয়ে চলে আসবেন।)
‘হোম কোয়ারেন্টিনের অর্থ হইতেসে যে, সে একলা নিজের ঘরের ভিতরে থাইকবো। নিজের বিবি বাইচ্চা কারোগোরে সে হাত দি ধইত্তো ফাইত্তো নো।’
(হোম কোয়ারেন্টিনের অর্থ হচ্ছে যে, তিনি একলা নিজের ঘরে থাকবেন। নিজের স্ত্রী সন্তান কাউকে হাত দিয়ে ধরতে পারবেন না।)
‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ দিসে আপনাগো ভায়রাগো বাইত যায়া বেড়াইবেন, নানিগো বাড়িত যাই বেড়াইবেন, ইতাল্লাই নো। এটা বন্ধ দিসে আপনার হোলা মাইয়াগুনরে আপনার বাড়িত রাইখবেন। যদি বাড়িত্তুন বাইর হই যায় কোন করোনাভাইরাস আলা রোগীরে যদি আন্নের হুতে বা আন্নের জি-এ দরে আর হেতে আইলে হেতেরে আপনে ধইরবেন, ব্যাকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হইবো।’
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লাঠি পেটা
অবশ্য টাঙ্গাইলসহ আরও কয়েকটি জেলায় কয়েকদিন আগ পর্যন্ত লাঠিপেটা করেই মানুষকে বাড়িতে থাকার বিষয়ে সতর্ক করতে দেখা গেছে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে রাস্তায় বের হওয়া মানুষকে লাঠিপেটা করায় টাঙ্গাইলের একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর বেশ সমালোচনার মুখে পড়েন। তার বিরুদ্ধে থানায় মামলাও হয়। এরপর ওই জেলায় আর এমন লাঠিচার্জের খবর পাওয়া যায়নি।
সচেতন মহলের প্রচারণা
প্রশাসনের পাশাপাশি সমাজের তরুণ সমাজও ব্যতিক্রম নানা উপায়ে প্রচারণা চালিয়েছেন, যেমন রাজশাহীর তরুণ সাইক্লিস্টরা মুখে মাস্ক এবং হাতে গ্লভস পড়ে সাইকেল চালিয়ে পবা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে করোনাভাইরাস বিষয়ে লিফলেট বিতরণ ও প্রচারণা চালিয়েছে।
Comment here