সালমানের শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয় - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
বিনোদন

সালমানের শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়

সালমান শাহ, চলচ্চিত্রের ধ্রুবতারা। মাত্র ২৭টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। দর্শক এখনো মুগ্ধ হয়ে সেগুলো দেখেন। ১৯৯৬ সালের আজকের দিনে অসংখ্য ভক্তকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান এ অভিনেতা। মৃত্যুর এত বছর পেরিয়ে এখনো ভক্তদের অন্তরে চিরসবুজ হয়ে আছেন এ স্বপ্নের নায়ক। অমর এ নায়ককে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন তার সহশিল্পীরা

মৌসুমী

এই দিনটির কথা ভুলে থাকতে চাই! পারি না। বারবার মনে হয়, সালমান যদি বেঁচে থাকত আমাদের চলচ্চিত্র নিয়ে মানুষ এতটা হতাশ হতো না। অনেক এগিয়ে যেত আমাদের চলচ্চিত্র। সালমানের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছিল ‘তুই’-এর। যখনই দেখা হতো, অনেক মজা করতাম আমরা। খুবই আবেগপ্রবণ ছেলে ছিল সে। একটা গল্প শোনাই- আমরা এফডিসিতে একটা ছবির শুটিং করছিলাম। সেদিন কোনো কারণে ওর মনে হলো, আজকে শুটিং করবে না। আমাকে এসে বলল, ‘দোস্ত আজকে শুটিং করব না। তুই শুটিং প্যাকআপের ব্যবস্থা কর।’ আমি বললাম, ‘আজকে আমাকে শুটিং করতে হবে। তা না হলে শিডিউল ওলটপালট হয়ে যাবে।’ ও আমাকে কিছুই বলল না। কিছুক্ষণ পর দেখলাম, ওয়াশরুম থেকে সালমান বের হচ্ছে। ওর হাত থেকে রক্ত পড়ছে। আমরা সবাই তখন দৌড়ে ওর কাছে গেলাম। ও বলল, ওয়াশরুমে পা পিছলে পড়ে গিয়ে হাত কেটে গেছে। পরে বাধ্য হয়েই শুটিং বাতিল করতে হলো। পরে জানলাম, সে ব্লেড দিয়ে হাত কেটে ফেলেছে। ওর আবেগের কাছে আমাদের অনেকবার হারতে হয়েছে। আমার এ আবেগপ্রবণ বন্ধুটাকে খুবই মিস করি। চলচ্চিত্রে সালমানের অবদান কখনই ভোলা যাবে না। ও আমাদের চলচ্চিত্রের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। আমার এ বন্ধুটার শূন্যতা সব সময় মনে পড়ে।

রিয়াজ

সালমানপরবর্তী সময়ে আমি কাজ করেছি। কিন্তু আমি নিজে কখনই বা কেউ দাবি করতে পারবে না সালমানের অভাব আমরা পূরণ করতে পেরেছি। কেউই আসলে কারও জায়গা নিতে পারে না বা বিকল্প হতে পারে না। সালমানের যে ক্রেজটা ছিল সেটি এখনো আছে। সালমান জাত অভিনেতা। সব শ্রেণির দর্শককে সে জয় করতে পেরেছিল। তার মধ্যে কী যেন একটা ছিল, যা দর্শককে টানত। সহশিল্পী হিসেবেও তাকে দেখতাম অবাক হয়ে। আমার সঙ্গে দুটি সিনেমা ওর হয়েছিল। একটি সম্পূর্ণ হয়েছিল ‘প্রিয়জন’। আরেকটি শেষ হওয়ার আগেই ও চলে যায়। আমি তখন নতুন ছিলাম। আমার কাছে সব সময় মনে হতো যে সালমান বেঁচে থাকত, ওর সঙ্গে যদি আরও একবার স্ক্রিন শেয়ার করতে পারতাম! এমন একটি পার্সোনালিটি সম্পন্ন ব্যক্তির সঙ্গে আর দেখা হবে না, এটি ভাবলেও মন খারাপ হয় খুব। তার এভাবে মৃত্যু মেনে নেওয়া যায়নি, যাবেও না। যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক সালমান শাহ, এটিই দোয়া করি।

শাবনূর

আমার প্রিয় নায়কদের তালিকা করলে শুরুতেই থাকবে তার নাম। তার অভিনয়ে আমি মুগ্ধ, এখনো। সালমানকে প্রথম দেখি এফডিসিতে। মৌসুমী আপুর সঙ্গে শুটিং করছিলেন। আসা-যাওয়ার মধ্যেই দেখা হতো। আনুষ্ঠানিক পরিচয় ‘তুমি আমার’ ছবিতে অভিনয় করার সময়। এক সময় কাজের কারণে বন্ধুত্ব হয়। সালমান থাকবে আমার স্মৃতিতে, যতদিন বেঁচে আছি। আমি মনে করি, সালমান বেঁচে থাকলে উত্তম-সুচিত্রার জুটির মতোই আমাদের জুটি হতো। দর্শক সেভাবেই গ্রহণ করতেন। আর আমাদের চলচ্চিত্রের অবস্থাও এখনকার মতো হতো না। আমাদের নিয়ে প্রেমের গুজব থাকলেও সালমানকে আমি ভাই ছাড়া আর অন্য কোনো চোখে দেখতাম না। আমি আমার ক্যারিয়ারটা অনেক কষ্ট করে তৈরি করেছি। তিল তিল করে গড়ে তুলেছি। কিছুসংখ্যক লোক গুজব ছড়িয়ে আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা করেছে। সালমান অনেক বড় মনের মানুষ। বয়সে বড় সবাইকে সে যথেষ্ট সম্মান করত। কোনো অহংকার তার মধ্যে ছিল না। সহশিল্পীদের সবার প্রতি খুব আন্তরিক আর কাজপাগল ছিল। আমাদের দুজনের বোঝাপড়াটা ছিল চমৎকার। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি তার মৃত্যু সংবাদ শোনার পর। তার মৃত্যু সংবাদ যখন পাই, তখন আমি বাসায় ছিলাম। হঠাৎ করে কে যেন ফোন করে জানায়, সালমান মারা গেছে। আমি উল্টো ধমক দিয়ে বলি, কী বলে এসব! আমার ছোট বোন সালমানের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে। আমি পুরোপুরি হতবাক হয়ে যাই। তাকে যদি আবার ফিরে পেতাম তা হলে জানতে চাইতাম- তুমি কেন মরে গেলে? তোমার কী কষ্ট ছিল? তোমার তো কোনো কিছুরই অভাব ছিল না?

ফেরদৌস

সালমান অকালে চলে যাওয়ায় ছটকু আহমেদ পরিচালিত ‘বুকের ভেতর আগুন’ চলচ্চিত্রটি মাঝপথে আটকে যায়। সালমান শাহের অংশে গল্পে কিছুটা পরিবর্তন করে অসমাপ্ত কাজ শেষ করার উদ্যোগ নেন পরিচালক। আমি সেই ছবিতে যুক্ত হই আমির হোসেন বাবুর মাধ্যমে। সালমান শাহর স্থলাভিষিক্ত হয়েই চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু হয় আমার। আমি যখন সিনেমায় আসি আমার পরিবার জানতে চেয়েছিল সিনেমায় আসার কারণ। আমি সালমান শাহকে দেখিয়ে বলেছিলাম তার মতো নায়ক হতে চাই। সালমান শাহ আমার ও আমাদের অনুপ্রেরণা। আমাদের অনেক কিছু দিয়ে গেছেন তিনি। এটি সত্যি তার মতো এত স্টাইলিস নায়ক আমাদের নেই, আসবেও না। আমাদের চলচ্চিত্রে তার নামটা সব সময়ই উচ্চারিত হবে।

শাবনাজ

এক কথায় অসাধারণ একজন মানুষ ও নায়ক ছিল। আকাশছোঁয়া তারকাখ্যাতি থাকলেও তার কোনো অহংকার ছিল না। সবাইকে সম্মান করে কথা বলত। সিনিয়রদের প্রতি তার আচরণ ছিল দারুণ। আমরা সমবয়সী ছিলাম। কিন্তু সিনেমায় ওর আগে এসেছি সেটি সে মূল্যায়ন করত। ও যখন শুনত আমি সেটে এসে গেছি, দেরি করত না। সদালাপী, আড্ডাবাজ ছিল। ভীষণ ডানপিটে। শুটিং সেটে সালমান থাকা মানেই হাসি-আনন্দ লেগে থাকা। আর নায়ক হিসেবেও ছিল সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে। আধুনিক মানসিকতার একটা ছেলে। ওর স্টাইল, ফ্যাশন সব কিছুই আমাদের ইন্ডাস্ট্রির জন্য নতুন আর ইউনিক ছিল। চলাফেরা, কথাবার্তা, তাকানো, হাসা- সব কিছুতেই একটা উন্নত রুচির ছাপ সে মেইনটেইন করত। এ কারণেই ও অন্য নায়কদের থেকে নিজেকে আলাদা করতে পেরেছিল। সালমানের সঙ্গে আমি মায়ের অধিকার, আঞ্জুমান ও আশা ভালোবাসা- এ তিনটি ছবিতে অভিনয় করেছি। আমাদের সম্পর্কটা বেশ মজার ছিল। দেবর ভাবির। নাঈমের স্ত্রী হিসেবে সালমান আমাকে ভাবি বলেই ডাকত। সেই সম্মানটাও করত সে। আবার আমরা ভালো বন্ধুও ছিলাম। সালমানের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় কেয়ামত থেকে কেয়ামত সিনেমার সময়। প্রথমে আমাকে ও নাঈমকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল ছবিটির জন্য। তখন আমাদের জুটি টিনএজদের কাছে খুব পপুলার। কিন্তু সেই সময় আমরা দুজনে লাভ নামের ছবিটা করছিলাম। একে তো শিডিউল দেওয়া ছিল তার ওপর লাভ ও কেয়ামত থেকে কেয়ামত ছবি দুটির গল্প কাছাকাছি। তাই করা হয়নি। পরে সালমান আর মৌসুমী করল। আরও মজার একটা ব্যাপার হলো যে চাঁদনী ছবি দিয়ে আমার অভিষেক হলো সেটি মৌসুমীর করার কথা ছিল। কোনো কারণে ও করেনি, ভাগ্যচক্রে সেটি দিয়ে আমি শুরু করি।

Comment here