ইঞ্জিন-ফেইলিউর বাড়ছে - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
অন্যান্য

ইঞ্জিন-ফেইলিউর বাড়ছে

বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্রেনগুলোতে বেড়ে গেছে ইঞ্জিন ফেইলিওরের মতো অনভিপ্রেত কা-। এতে করে সময়সূচি ঠিক রাখা যাচ্ছে না, এড়ানো যাচ্ছে না যাত্রীদুর্ভোগ। শুধু তাই নয়, খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে ট্রেনযাত্রা। এমনও হয়েছে যে, ঝরেপড়া একটি শুকনো পাতার কারণেও বিগড়ে গেছে ইঞ্জিন; যাত্রায় দেরি হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা। এমন তথ্য পাওয়া গেছে সংশ্লিষ্টদের দাপ্তরিক ব্যাখ্যায়। তদুপরি যন্ত্রাংশ সংকট, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবসহ যোগ হয়েছে নানা কারণ। সব মিলিয়ে রেলের অবস্থা খুবই বেগতিক। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা যদি তৎপর হতেন, তবে এহেন দশা থেকে পরিত্রাণ বা মুক্তি পাওয়া যেত শিগগিরই। কিন্তু তাদের মধ্যে দায়িত্ব সম্পাদনের চেয়ে দায় এড়ানোর প্রতিযোগিতাই অধিকতর চর্চিত।

জানা গেছে, রেলে হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে ইঞ্জিন ফেইলিওর। সঙ্গত কারণেই বেড়ে যাচ্ছে যাত্রাবিলম্বও। গত ৩০ ডিসেম্বর রেলভবনে অনুষ্ঠিত অপারেশনাল রিভিউ মিটিংয়ে (ওআরএম) এসব তথ্য উঠে এসেছে। এতে জানানো হয়, গত অক্টোবরে ৮টি এবং নভেম্বরে পশ্চিমাঞ্চলে ৯টি ইঞ্জিন বিকলের ঘটনা ঘটে। অথচ ২০১৯ সালজুড়ে মাত্র দুবার ইঞ্জিন বিকলের ঘটনা ঘটেছিল।

পর্যালোচনা বৈঠকের তথ্যমতে, গত নভেম্বরে ৯টি ইঞ্জিন ফেইলিওরের মধ্যে ৬টি ছিল পাকশীতে এবং ৩টি লালমনিরহাট বিভাগে। আর ৯টি ইঞ্জিন ফেইলিওরের মধ্যে ৬টির জন্যই দায়ী করা হয়েছে ‘বস্তুগত বিকলতা’কে। বাকি ৩টি ইঞ্জিন ফেইলিওরে রেলওয়ের বিভিন্ন বিভাগের কর্মচারীদের দায়ী করা হলেও কোনো কর্মকর্তাকে দায়ী করা হয়নি। উপরন্তু দায়ীদেরও শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি।

জানতে চাইলে রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (পশ্চিমাঞ্চল) মিহির কান্তি গুহ বলেন, বস্তুগত অসুবিধার কারণে এ সমস্যা হচ্ছে। ইঞ্জিনের মেয়াদ পার হওয়া, যন্ত্রাংশের অভাবসহ নানা কারণে এমনটি হচ্ছে।

জানা গেছে, সান্তাহার-বুড়িমারী রুটের করতোয়া এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন বিকল হয় ২৭ নভেম্বর। ৭১৩ আপ ট্রেনটি বুড়িমারী পৌঁছার পর ৭১৪ হিসেবে ডাউন ট্রেনের কাজ করতে গিয়ে দেখা যায়, ইঞ্জিন ফরমোস্টে (লংহডে) মুভ করে না। পরে ডেড অবস্থায় লালমনিরহাট লোকোশেডে গেলে পরীক্ষা করে রিভার্স কন্টাক্টের ২নং কন্টাক্টের মাঝে ‘শুকনো পাতা’ পাওয়া যায়। পাতাটি সরিয়ে ইঞ্জিন কার্যোপযোগী করা হয়। এতে ট্রেনটির ৩ ঘণ্টা ২০ মিনিট দেরি হয়।

সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, ২৬ নভেম্বর রাজশাহী-চিলাহাটি রুটে চলা বরেন্দ্র এক্সপ্রেসের (৭৩২ ডাউন) ইঞ্জিন বিকল হয়। সে সময় ট্রেনটিতে ৬৫১৪নং ইঞ্জিন যুক্ত ছিল। চিলাহাটি থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনটি সাহাগোলা স্টেশনে ইঞ্জিন শাটডাউন হয়ে বিকল হয়ে যায়। এতে ৬৫১৩নং রিলিফ ট্রেন পাঠিয়ে কাজ করানো হয়। তবে দুই ঘণ্টা ১৩ মিনিট ট্রেনটি আটকে ছিল। পরে ৬৫১৪ ‘ডেড’ অবস্থায় ঈশ্বরদী লোকোশেডে আসার পর চেক করে দেখা যায় যে, এমইপি এমসিসি কার্ড খারাপ। সেই কার্ড পরিবর্তন করে ইঞ্জিনটি ফিট করা হয়। তবে এ ঘটনায় কাউকে দায়ী করা হয়নি। বরং বস্তুগত বিকলতা দেখানো হয়েছে। একইভাবে ২৯ নভেম্বর বিকল হয় ঢাকা-চাঁপাইনবাবগঞ্জ রুটে চলা বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিন।

৬৫০৬নং ইঞ্জিন নিয়ে ডাউন ট্রেনটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে কাজ করার সময় দেখা যায় একটি ট্রাকশন মোটর কম আছে। এর পরও ট্রেনটি রওনা হলে ওই লাইন আপগ্রেডিং এবং ঘন কুয়াশার কারণে হুইল সিøপ হয়ে লোকো লস হিসেবে এক ঘণ্টা ১০ মিনিট হওয়ার কারণে লোকো বিকলতা হিসেবে গণ্য হয়। কিন্তু এ ঘটনায়ও কাউকে দায়ী করা হয়নি। বরং বস্তুগত বিকলতা দেখানো হয়েছে। এদিকে ইন্ডিপেনডেন্ট ব্রেক ভাল্ব রিলিজ না হওয়ায় ১১ নভেম্বর বিকল হয় দিনাজপুর কমিউটার (৬১ আপ)। এতে এক ঘণ্টা ২০ মিনিট বিলম্ব হয় ট্রেনটি। আর ২৬ নভেম্বর হয় বিকল হয় সান্তাহার আপ ট্রেনের ২৩০৩নং ইঞ্জিন। লো-ভোল্টেজ গ্রাউন্ডের জন্য পার্বতীপুর শেডে এটি পরীক্ষা করা যায়নি। কিন্তু এ দুই ঘটনার জন্য কাউকে দায়ী করা হয়নি। বরং বস্তুগত বিকলতা দেখানো হয়েছে।

সূত্র আরও জানায়, রাজশাহী-বাংলাবান্ধা রুটে চলাচল করে বাংলাবান্ধা এক্সপ্রেস (৮০৩ আপ ও ৮০৪ ডাউন) ট্রেন। গত ৮ নভেম্বর ট্রেনটিতে ৬৫১৩নং ইঞ্জিন সংযুক্ত ছিল। রাজশাহী থেকে ছেড়ে যাওয়া ৮০৩নং আপ ট্রেনটি মাধনগর স্টেশনে পৌঁছলে ৩নং বিয়ারিংয়ের এক্সেল বক্স সিজড্ হয়ে ইঞ্জিনটি বিকল হয়ে যায়। পরে ৬৫০২নং ইঞ্জিন থেকে একটি ট্রলি পরিবর্তন করে ৬৫১৩নং ইঞ্জিনটি ফিট প্রদান করা হয়। যদিও এ ঘটনায় কাউকে দায়ী করা হয়নি। বরং বস্তুগত বিকলতা বলে দায় এড়িয়ে যান সংশ্লিষ্টরা। অথচ ইঞ্জিন বিকল হওয়ায় ৪ ঘণ্টা ১০ মিনিট ট্রেনটি বিলম্ব হয়।

একই ধরনের ঘটনা ঘটে খুলনা-চিলাহাটি রুটে চলাচলকারী রূপসা এক্সপ্রেস (৭২৭ ও ৭২৮) ট্রেনে। ওই দিন ৬৪০৩নং ইঞ্জিন নিয়ে খুলনা থেকে ৭২৭ আপ ট্রেন যাত্রা শুরু করে। তবে নীলফামারী স্টেশনে ইঞ্জিন কুলিং ওয়াটারের সব পানি পড়ে গিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। এতে ১ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট ট্রেনটি বিলম্ব হয়। পরে ইঞ্জিনটি পার্বতীপুর লোকোশেডে আসার পর চেক করে দেখা যায়, এল-৮ সিলিন্ডারের পিস্টন, কানেক্টিং রড এবং সিলিন্ডার লাইনার ভেঙে গিয়ে পানি পড়ে গিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। তবে এ ঘটনায় কাউকে দায়ী করা হয়নি। বরং বস্তুগত বিকলতা বলে দায় এড়িয়ে যান সংশ্লিষ্টরা।

এ সংক্রান্ত বৈঠকের তথ্যমতে, নভেম্বরে পশ্চিমাঞ্চলে প্রথম ইঞ্জিন ফেইলিওর হয় পদ্মা এক্সপ্রেসে (৭৫৯ আপ ট্রেন)। গত ১ নভেম্বর ঢাকা থেকে রাজশাহীর পথে রওনা হওয়া ট্রেনটিতে ৬৫০৮নং ইঞ্জিন যুক্ত ছিল। বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব স্টেশনে পৌঁছানোর পর ৫নং ট্রাকশন মোটরের ফিল্ড কানেকশন জ্বলে যাওয়ার কারণে ইঞ্জিন হুইল সিøপ করে। পরে আর ইঞ্জিনটি চলেনি। পরে লোকোমাস্টার ও সহকারী লোকোমাস্টার এএমই (লোকো), ঈশ্বরদী এসএসএই (এম), রাজশাহীর সঙ্গে যোগাযোগ করে ৫নং ট্রাকশন মোটর কেটে ইঞ্জিনটি ১ ঘণ্টা পর চালু করা হয়। এ বিকলতার জন্য রেলের এলএম ও এএলএমকে দায়ী করা হয়। এ ঘটনায় ৩ ঘণ্টা ৪ মিনিট বিলম্ব হয় ট্রেনটি। একই ধরনের ঘটনা ঘটে ১৩ নভেম্বর খুলনা-চিলাহাটি রুটে চলাচলকারী সীমান্ত এক্সপ্রেস (৭৪৭নং আপ) ট্রেনে। ওই দিন খুলনা থেকে ট্রেনটি যাত্রা শুরুর সময় ৬৪০৫ ইঞ্জিন যুক্ত ছিল। ট্রেনটি দর্শনা জংশন হয়ে চুয়াডাঙ্গা স্টেশনে গেলে মেশিন ফিল্টার হাউজিং লিকেজ হয়ে ইঞ্জিনের লুব অয়েল পড়ে গিয়ে বিকল হয়ে যায়। এতে ২ ঘণ্টার বেশি ট্রেনটি বিলম্ব হয়। ইঞ্জিনটি ঈশ্বরদী লোকোশেডে গেলে পরীক্ষা করে দেখা যায়, লুব অয়েল ফিল্টার হাউজিংয়ের বাইপাস পাইপ লাইনের আরমোর্ড গ্যাসকিট ফেটে লুব অয়েল পড়ে যায়। পরে আরমোর্ড গ্যাসটি পরিবর্তন করে লোকোমোটিভটি ফিট করা হয়। এ ঘটনার জন্য খুলনা লোকোশেডের ফিটিং কর্মচারীদের দায়ী করা হয়।

Comment here