এক দফা আন্দোলনে নামছে বিএনপি - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
রাজনীতি

এক দফা আন্দোলনে নামছে বিএনপি

নজরুল ইসলাম : কারাবন্দি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির ইস্যুতে রাজপথে আন্দোলন কর্মসূচি দেওয়া না-দেওয়া নিয়ে দুধরনের চাপে পড়েছে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। এক, রাজপথের কর্মসূচি না দেওয়ায় দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা নীতিনির্ধারকদের প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে সমালোচনা করছেন। এ সমালোচনা থেকে বাদ যাচ্ছেন না দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও। আবার রাজপথে কর্মসূচি দিলে মামলা, গ্রেপ্তার, হামলা ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। কিন্তু দলের বেশিরভাগ সিনিয়র নেতা আন্দোলন করে আর কারাগারে যেতে চান না।

চাপের মধ্যে থাকা দলের নীতিনির্ধারকদের উপলব্ধি হয়েছে, এ সরকার যতদিন ক্ষমতায় থাকবে, ততদিনে খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন না। দলীয়ভাবে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত না নিলে সিদ্ধান্ত ছাড়াই কোনো না কোনো নেতা খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে নিজ নিজ উদ্যোগে রাজপথে নেমে পড়বেন। সম্প্রতি জাতীয়তাবাদী মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম দলের ব্যানারে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানের নেতৃত্বে কয়েক হাজার নেতাকর্মীর সুপ্রিমকোর্টের মূল ফটকে অবস্থান তারই আলামত বলে মনে করা হচ্ছে। আরও অনেকে প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে নীতিনির্ধারকদের কাছে খবর আছে।

এরই মধ্যে ২০-দলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা কর্নেল (অব) অলি আহমেদ মুক্তিমঞ্চ গঠন করে আন্দোলনের মধ্যে আছেন। এভাবে চলতে থাকলে সব কিছু বিএনপির বাইরে চলে যাবে। ফলে দলের চেইন অব কমান্ড বলতে কিছুই থাকবে না। এ অবস্থার মধ্যে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা আমাদের সময়কে বলেন,  খালেদা জিয়ার জামিনের মূল বাধা সরকার ও সরকারপ্রধান। যদি তাকে জামিনে মুক্তি দেওয়া না হয়, তা হলে তারা এক দফার সরকার পতনের কথাই ভাবছেন। এই নিয়ে দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ লক্ষ্যে আজ শনিবার স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডাকা হয়েছে গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আজকে আওয়ামী লীগ সরকার ১০-১২ বছর ধরে এ অবস্থা তৈরি করেছে যেখানে মানুষ তার কথা বলতে পারবে না, মানুষ তার ব্যথা-দুঃখ-ক্ষোভের কথা জানাতে পারবে না। একাত্তর সালে যুদ্ধ করে পাকিস্তানকে বিদায় দিয়েছে, নব্বই সালে স্বৈরাচার এরশাদকেও এ দেশের মানুষই সরিয়েছে। এখন আপনারা (সরকার) চিন্তা করছেন, সারাজীবন থেকে যাবেন। এটার (সরকার) ঘণ্টা বেজেছে। চারদিকে বিদায় ঘণ্টার ধ্বনি শোনা যাচ্ছে।

বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের কার্যালয়ের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, আন্দোলনে নামার আগে দলের নীতিনির্ধারকরা দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ভাবছেন। এর একটি হচ্ছে ভবিষ্যতে সভা-সমাবেশের জন্য পুলিশের অনুমতির অপেক্ষা না করা। এ ক্ষেত্রে কর্মসূচির জন্য অনুমতির আবেদন না করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার কথা চিন্তা করা হচ্ছে। অন্যটি হচ্ছে, হয়রানির প্রতিবাদ হিসেবে সারাদেশে পুলিশের দায়ের করা ‘গায়েবি’ মামলায় একযোগে আদালতে হাজিরা না দেওয়া।

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমরা যদি দেখি, ৫ ডিসেম্বর বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি হয়নি, তা হলে এ দেশে এক দফার আন্দোলন হবে। তা হবে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের আন্দোলন। তবে এ নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

দলীয় একাধিক নেতা আমাদের সময়কে বলেন, ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাগারে আছেন খালেদা জিয়া। তিনি কারাবন্দি হওয়ার পর দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে জাতীয় নির্বাহী কমিটি ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কমিটির নেতাদেরও তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। দল পরিচালিত হয়েছে লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দেশে অবস্থানরত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির নেতাদের যৌথ নেতৃত্বে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া, নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথগ্রহণ, জাতীয় সংসদে যোগ দেওয়াসহ সব সিদ্ধান্ত নেয় এ যৌথ নেতৃত্ব। তবে, সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার মতো কোনো আন্দোলন রাজপথে দৃশ্যমান হয়নি। শুধু পুলিশের অনুমতি সাপেক্ষে মানববন্ধন, অনশন ইত্যাদি কর্মসূচি দেওয়া নিয়ে দলের মধ্যে নানা সমালোচনা হয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, দেশের মানুষ পরিবর্তন চায়। তারা এখন সরকারের ওপর অতিষ্ঠ হয়ে এ পরিবর্তন চায়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকারের নিয়ন্ত্রণ আস্তে আস্তে শিথিল হচ্ছে। দেশের মানুষ বিএনপিকে আন্দোলনের জন্য প্রচুর চাপ দিচ্ছে।

শুরু থেকেই রাজপথের আন্দোলনের পক্ষে থাকা স্থায়ী কমিটির দুই নেতা বলেন, চেয়ারপারসন কারাবন্দি হওয়ার পর থেকে দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা বলছেন, জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা হবে। ২০-দলীয় জোটকে গুরুত্বহীন করে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সৃষ্টি করা হলো। আন্দোলনের কথা বলা হলে নেতাকর্মীদের মামলা-গ্রেপ্তার থেকে রক্ষার দোহাই দিয়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এসব করে কী লাভ হয়েছে?

সারা দেশে মামলার তথ্য সংগ্রহের জন্য গঠিত বিএনপির মনিটরিং সেল সূত্র জানায়, ২০০৯ থেকে ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত বি?এনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ নেতাকর্মী সমর্থকদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ১ হাজার ৯৮৬টি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় নামে-বেনামে আসামির সংখ্যা ৩৫ লাখ ৯৫ হাজার ৯০৫ জন। এর মধ্যে বর্তমানে জেলে আছেন ১ লাখ ৪ হাজার ৮০৪ জন।
স্থায়ী কমিটির ওই দুই নেতা বলেন, দেখেন মামলা থেকে নেতাকর্মীরা রক্ষা পাননি। এখন ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট উভয় জোটই গুরুত্বহীন হয়ে গেছে। খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করে জেএসডির আসম রব ও নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না জোরালো বক্তব্য দিলেও ড. কামাল কৃপণতা দেখান।

জানতে চাইলে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আমাদের সময়কে বলেন, গণতন্ত্রের মা খালেদা জিয়াকে সরকার রাজনৈতিক কারণে গ্রেপ্তার করেছে। এখানে আইনের কোনো বিষয় নয়। এ সরকার থাকলে তিনি মুক্তি পাবেন না। আন্দোলনের মাধ্যমেই তাকে মুক্ত করতে হবে। এটা শুরু থেকেই বলে আসছি। অবশ্য যেসব নেতা এতদিন শান্তিপূর্ণ আন্দোলন আন্দোলন বলে চিৎকার করেছিলেন, সেসব নেতাও বলতে শুরু করেছেন আন্দোলন ছাড়া খালেদা জিয়ার মুক্তি হবে না।
খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে গত ২৬ নভেম্বর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানের নেতৃত্বে সুপ্রিমকোর্টের সামনে ঘোষণা ছাড়াই অবস্থান নেওয়াকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে নেতাকর্মীদের ধাওয়া পাল্টাধাওয়া ও গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় ৫ শতাধিক নেতাকর্মীর নামে মামলা দেওয়া হয়েছে। বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। এ মামলায় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম, মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কেও আসামি করা হয়েছে। তারা আগাম জামিন নিয়েছেন। এ বিষয়ে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, রাজনৈতিক বক্তব্যের ওপর কখন কী মামলা হয়? তা হলে ওবায়দুল কাদের কী করে বলেন, আমাদের মুরোদ নেই, আন্দোলন করার ক্ষমতা নেই। এটা কি উসকানি নয়? পুলিশ এই উসকানিমূলক বক্তব্যের জন্য কী করেছে। সভা-সমাবেশ, মিছিল করা নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। সংবিধানের কোথায় আছে পুলিশের অনুমতি ছাড়া মিছিল করা যাবে না। গত রবিবার রাজধানীর নয়াপল্টনের সমাবেশে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এখন আর অন্য কোনো সেøাগান নয়। একটাই সেøাগান, এই সরকার নিপাত যাক। আর কোনো বিভেদ নয়, একসঙ্গে আমাদের আন্দোলনে নেমে পড়তে হবে। অতিদ্রুত রাজপথে নেমে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনব, দেশনেত্রীকে মুক্ত করব।’

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি, ‘বিএনপির শুভাকাক্সক্ষী’ হিসেবে পরিচিত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মনে করেন- বিএনপি নেতারা অলস হয়ে গেছেন। লন্ডনের ওহির অপেক্ষায় বসে থাকেন। এভাবে আন্দোলন হয় না।’

হঠাৎ করে সিনিয়র নেতাদের কিছু না জানিয়ে এমন আন্দোলনে নামায় বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বও হতবাক। ওইদিনের কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, কর্মীরা প্রস্তুত। কিন্তু নেতারা তো নির্দেশনা দিচ্ছেন না। সেদিন কিন্তু হাজার হাজার নেতাকর্মী সেখানে ছিলেন না। প্রেসক্লাবের অনুষ্ঠানে হাজার তিনেক মানুষ ছিলেন। আর মিছিলের সময় ছিলেন দেড় হাজারের মতো। তাতেই একটা বার্তা দেওয়া গেছে। খালেদা জিয়ার জামিনের শুনানি যখন চলছে, তখন জজ সাহেবদের একটা বার্তা দিতে হবে। তারা যেন নির্ভয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। সবাই ঘরে বসে থাকলে খালেদা জিয়ার মুক্তি মিলবে না। বিএনপির যে আন্দোলনের সামর্থ্য আছে, সেটাও বুঝিয়ে দিতে হবে।

Comment here