একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির জয়ীদের শপথগ্রহণ নিয়ে দলটির ভেতরে সংকট চলছে। দলের শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ প্রকাশ্যে পরস্পরবিরোধী মন্তব্য করছেন। তবে দলটি নির্বাচনের আগে-পরে সবসময়ই ২০ দলীয় জোটের মিত্রদের পাশে পেয়েছে।
না জানিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা হুট করে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন নিয়ে জোটমিত্রদের ক্ষোভ থাকলেও একই ছাতাতলে ছিল দলগুলো। একাদশ সংসদ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান, পুনর্নির্বাচন দাবি, সংসদে না যাওয়ার মতো বিষয়ে ঐকমত্য নিয়ে একসঙ্গে চলছিল তারা। কিন্তু কাউকে না জানিয়ে হঠাৎ করে বিএনপির সংসদে যোগদানের সিদ্ধান্ত এ জোটের রক্ষাবাঁধে ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে।
ইতোমধ্যে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জোটটি ছেড়েছে আন্দালিব রহমান পার্থের বিজেপি। জোট ছাড়ার হুমকি দিয়েছে আরও কয়েকটি দল। জাতীয় সংসদে যোগদানের পর সব মিলিয়ে ২০ দলীয় জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন সংকটে পড়েছে বিএনপি।
বিজেপির মতো আরও কয়েকটি শরিক দলও বিদ্রোহী মনোভাব দেখাচ্ছে। ২৩ মের মধ্যে ঐক্যফ্রন্ট না ছাড়লে জোট ছাড়ার আলটিমেটাম দিয়েছে লেবার পার্টি। এলডিপি, কল্যাণ পার্টিসহ আরও কয়েকটি দলও একই পথে এগোচ্ছে।
জোটভুক্ত দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঐক্যফ্রন্টকে ‘অতিগুরুত্ব’ দেওয়া, ২০ দলের বৈঠক না হওয়া, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের আগে মতামত না নেওয়া এবং কর্মসূচি প্রণয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাদের অবহিত না করায় ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি বিএনপির একক সিদ্ধান্তে তাদের নির্বাচিত ৫ নেতা সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছেন। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে জোটের সঙ্গে আলোচনা না করায় তীব্র হয়েছে ক্ষোভ ও অসন্তোষ।
জোট নেতাদের বক্তব্য, ২০ দল নির্বাচনী জোট। নির্বাচনের যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তাদের মতামত নেওয়া হলেও এমপিদের শপথ নেওয়ার আগে মতামত জানার প্রয়োজনই মনে করা হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ২০ দলের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান আমাদের সময়কে বলেন, ‘নীতিগত কারণে ২০ দলীয় জোটের দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। বহু বছর একসঙ্গে কাজ করছি, আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি, নির্বাচন করেছি। আমাদের মধ্যে কখনো কখনো মতের বিরোধ হতেই পারে। এটা সাময়িক। আবার ঠিক হয়ে যাবে। তিনি বলেন, যারা ২০ দলে আছেন তাদের কেউই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ের বিরুদ্ধে নয়। দেশ, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং গণতন্ত্রের প্রশ্নে ২০ দলের সবাই এক।
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, এতদিন শরিক দলগুলোর অভিযোগ ও ক্ষোভ আমলে না নিলেও পার্থ জোট ত্যাগের পর বিরোধ কমাতে আলোচনা শুরু করেছেন বিএনপি নীতিনির্ধারকরা। তাই জোটের মধ্যকার বিরোধ কমাতে দলের স্থায়ী কমিটির এক সদস্যকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ওই নেতা পার্থের সঙ্গে গতকাল কথা বলেন। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে জোটের বৈঠক ডাকা হবে। পার্থকেও ওই বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানোর কথা রয়েছে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে ২০ দলের কার্যক্রম নেই বললেই চলে। গত ৪ মাসে জোটের কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি। এই সময়ের মধ্যে বৈঠক হয়েছে মাত্র দুটি। এসব বিষয় বিভিন্ন সভা-সমাবেশেও প্রকাশ্যে এনেছেন জোটের নেতারা।
এমনিতেই জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব বেড়েছে। দুই দলের কেউ কারও সঙ্গে যোগাযোগ করেন না। বিএনপির ভেতর থেকে জামায়াত ছাড়তে ব্যাপক চাপ রয়েছে। এর মধ্যে অন্য শরিকও অসন্তুষ্ট। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি নেতাদের আলোচনায় জোট ভেঙে দেওয়ার বিষয়টিও আসছে ঘুরেফিরে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে জোটের গুরুত্ব অনুধাবন করে সেই পথে হাঁটাকেও বিপজ্জনক মনে করছেন নেতারা।
বিএনপির সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা প্রসঙ্গে বিজেপি চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপির রাজনীতি ঐক্যফ্রন্টমুখী হয়ে পড়েছে। ২০ দলের গুরুত্ব তাদের কাছে আছে বলে মনে হচ্ছে না। যেখানে আমাদের গুরুত্বই থাকছে না সেখানে থেকে লাভ কী?
পার্থর জোট ছাড়ার বিষয়ে ২০ দলের একাধিক শরিকের শীর্ষস্থানীয় নেতার সঙ্গে কথা হয়। এর মধ্যে কয়েকটি দলও পার্থর মনোভাবের সঙ্গে আগে থেকে একমত ছিলেন। ঐক্যফ্রন্ট গঠন ইস্যুতে তাদের সঙ্গে প্রথম থেকেই বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে। তা ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিএনপি জোটের মতামতকে গুরুত্ব দেননি বলেও তাদের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ শীর্ষস্থানীয় নেতারাও জোটের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ‘অবজ্ঞা’ করেন বলেও বিভিন্ন সময় বলে আসছেন। কিন্তু বিরোধ নিরসনে বিএনপি থেকে কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি।
২০-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশ লেবার পার্টি চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, ২৩ মের মধ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট না ছাড়লে ২০ দল ছাড়তে বাধ্য হব। ঐক্যফ্রন্ট তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের এজেন্ডা নিয়েই তারা কাজ করছে। এ কারণে বিএনপিকে ঐক্যফ্রন্ট ছাড়তে হবে।
বিএনপির কার্যক্রমে দীর্ঘদিন ক্ষুব্ধ এলডিপি। দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাৎ হোসেন সেলিম বলেন, পার্থ সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কারণ ২০ দলের কার্যকারিতা এখন আর নেই। বৈঠক হয় না, গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জোট শরিকদের মতামত নেওয়া হয় না। তা হলে এই জোটের কাজ কী? আমাদের চেয়ারম্যান কর্নেল (অব) অলি আহমদ দেশে ফেরার পর এলডিপিও সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি বলেন, নির্বাচনের পর সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল জোটের। হঠাৎ বিএনপি শপথের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বিষয়ে জোটকে আগে জানানোর দরকার ছিল। এমনকি শপথের পরও আলোচনা করতে পারত, কিন্তু তা-ও করা হয়নি।
এনপিপি চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বললেন, শপথ নেওয়ার আগে জোটের সঙ্গে আলোচনা করা দরকার ছিল। অবশ্য কল্যাণ পার্টি মহাসচিব আমিনুর রহমান বলেন, জোটে সংস্কার দরকার। যে থাকতে চায় না, তাকে চলে যেতে দেওয়াই ভালো।
Comment here