কাঠমিস্ত্রির কন্যা থেকে ঢাবিছাত্রী, খাদে পড়ে চুরমার জয়নবের পরিবারের স্বপ্ন - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

কাঠমিস্ত্রির কন্যা থেকে ঢাবিছাত্রী, খাদে পড়ে চুরমার জয়নবের পরিবারের স্বপ্ন

নাম তার জয়নব খাতুন। সবে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছেন। এখন ছিল চাকরির জন্য নিজেকে তৈরি করার সময়। তার আগে একটু ছুটিতে পাহাড় দেখতে যান জয়নব। কিন্তু এটাই যে হবে তার শেষযাত্রা, তা কেউ ভাবেনি।

ফিরে এসেই কর্মজীবন শুরু করে পরিবারের হাল ধরার কথা কথা ছিল জয়নবের। কিন্তু তা আর হল না।

শুক্রবার পাঁচটি চাঁদের গাড়িতে (জিপগাড়ি) চড়ে বান্দরবান জেলা শহর থেকে বগা লেকে যান পর্যটকরা। কেওক্রাডাং পাহাড়চূড়ায় ভ্রমণ শেষে শনিবার সকালে একসঙ্গে ফিরছিলেন তারা। পথে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রুমা-কেওক্রাডং সড়কের দার্জিলিংপাড়া এলাকায় ঢালু রাস্তা নামার সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি গাড়ি পাহাড়ি খাদে পড়ে যায়। প্রথমে হতাহতদের উদ্ধার করে স্থানীয় লোকজন ও বেড়াতে আসা পর্যটকরা। পরে সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা সবাইকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।

 

এই খাদেই শেষ হয়ে গেল জয়নবের জীবন। জয়নব ছাড়াও ওই যানের আরেক যাত্রী ডা. ফিরোজাও বেঁচে ফিরতে পারেননি। এছাড়া আহত হন আরও ১০ পর্যটক।

জানা গেছে, জয়নব এবং সাংবাদিক ও লেখক সজীব মিয়ার শাশুড়ি শীতের ছুটি কাটাতে পাহাড় বেছে নিয়েছিলেন।

উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী উপজেলার মণ্ডলপাড়া গ্রামের মেয়ে জয়নব। তার বাবা আবদুল জলিল একজন কাঠমিস্ত্রি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য গ্রামে বসেই প্রস্তুতি নেন জয়নব। সহপাঠীর কাছ থেকে নোট নিয়ে পড়াশোনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় টিকে যান। তার বাড়ির এলাকার মানুষের মুখে মুখে এই গল্প এখনও চালু।

বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের খরচ চালাতে টিউশনি ও নানা সংগঠনে কাজ করতেন জয়নব। সহশিক্ষা কার্যক্রমেও ছিলেন সরব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রেঞ্জার ইউনিটের সদস্য, হিমু পরিবহনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং ভ্রমণকন্যার সদস্য ছিলেন। তাদের সাথেই তার বান্দরবানে যাওয়া। মিশুক স্বভাবের বলে খুব সহজেই সহপাঠীদের কাছের হয়ে যেতে পারতেন জয়নব। বন্ধুবান্ধব, ছোট-বড় সবার সঙ্গে তার ছিল সুসম্পর্ক। সবাইকে আপন করে নিতে পারতেন নিমেষেই। বিপদে-আপদে খোঁজ রাখতেন সবার।

মেয়ের মৃত্যুতে কান্নাজড়িত কণ্ঠে আবদুল জলিল বলেন, “জয়নব পড়াশোনা শেষ করে ভালো একটা চাকরি করবে। স্বাবলম্বী করে তুলবে পরিবারকে। মেয়েকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল আমার। সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।”

এক ভাই ও দুই বোনের মধ্যে জয়নব ছোট। বড় ভাই মেহেদী হাসান বাবুর খুবই আদরের বোন জয়নব। বাবু ব্যবসা করতেন, এখন বেকার। বড় বোন জহুরা খাতুনের বিয়ে হয়েছে।

বড় ভাই মেহেদী হাসান বাবু বলেন, “সে ছিল আমাদের একমাত্র আশার আলো। তাকে ঘিরে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। জয়নব এভাবে চলে যাবে, তা কখনও ভাবতে পারিনি।”

প্রতিবেশী আবদুল আউয়াল বলেন, “অসচ্ছল পরিবারের সন্তান হয়েও অত্যন্ত মেধাবী ছিল জয়নব। লেখাপড়া শেষ করে ভালো চাকরি করবে, পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করবে। তাকে নিয়ে আমাদের এই স্বপ্ন ছিল।”

জয়নবের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলেন তার সহপাঠী ও বন্ধুবান্ধবরা। দাফন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী মাকছুদুল মামুন বলেন, কোনও দায়িত্ব দিলে জয়নব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করত।

রবিবার ঢাবির বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব হল ও কুড়িগ্রামের রৌমারীতে নিজ গ্রাম মণ্ডলপাড়ায় জানাজা হয় জয়নবের। পরে রৌমারী কেন্দ্রীয় কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়।

ঢাবির অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন শাহিরা আফরিন বলেন, ব্যক্তিগতভাবে জয়নবকে আমি চিনতাম। সে মেধাবী হওয়ায় অনেক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল।

Comment here