কারা হক মারল গরিব-এতিমদের - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

কারা হক মারল গরিব-এতিমদের

লুৎফর রহমান কাকন ও মো. মহিউদ্দিন  : এবারের কোরবানির ঈদে ব্যবসায়ীরা পশুর চামড়া না কেনায় তৃণমূলে পাওয়া যায়নি সঠিক দাম। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলো। কারণ মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলোর সারা বছরের আয়ের একটি বড় অংশ আসে দুই ঈদে জাকাত ও কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি থেকে। কিন্তু এ বছর নজিরবিহীন দরপতনের কারণে অনেক ব্যবসায়ী রাস্তাতেই চামড়া ফেলে চলে গেছেন।

অনেকে আবার ক্ষোভে মাটির নিচে পুঁতে ফেলেছেন চামড়া। আবার কোথাও কোথাও পড়ে আছে অবিক্রীত চামড়ার স্তূপ। এর মধ্যে অধিকাংশ চামড়াই বিভিন্ন মাদ্রাসা ও এতিমখানার জন্য দান করেছিলেন সাধারণ মানুষ। যাতে বিক্রির অর্থ দিয়ে এতিম ছাত্ররা মাদ্রাসায় পড়তে পারে। কিন্তু বেশিরভাগ মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, চামড়া সংগ্রহ এবং পরিবহনের পেছনে খরচ করে এ বছর এক টাকাও মিসকিন ফান্ডে জমা করতে পারেননি। ফলে আগামী এক বছর মাদ্রাসা পড়–য়া এতিম ছাত্রদের খরচ কীভাবে মেটানো যাবে তা নিয়ে তারা দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছেন।

জামিয়া মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়া ভূঁইয়াপাড়া নামে একটি মাদ্রাসা রয়েছে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইল এলাকায়। প্রতিষ্ঠানটির উন্নয়ন কর্মকা-ের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিপন ভূঁইয়া জানান, তাদের মাদ্রাসাটি মক্তব, হিফজ, কিতাবখানা, এতিমখানাসহ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। এর মধ্যে এতিমখানাটি চলে পুরোপুরি বিভিন্ন দানের ওপর। বিশেষ করে জাকাতের টাকা ও কোরবানি ঈদে পশুর চামড়া বিক্রি থেকে আসা অর্থের ওপরই তারা বেশি নির্ভর করেন। কিন্তু এ বছর চামড়ার কেনাবেচায় দুরাবস্থার কারণে এতিমখানাকে সারাবছর আর্থিক ক্ষতির মধ্যে থাকতে হবে। যার প্রভাব পড়বে এতিম শিশুদের ভরণপোষণ, খাবার-দাবার ও পড়াশোনায়।

এ মাদ্রাসার সভাপতি আবুল কাশেম ভূঁইয়া বলেন, আমরা বিগত বছরগুলোতে একটি পশুর চামড়া ৩২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছি। এ বছর অন্তত ৮০০ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারব, এমন একটি ধারণা ছিল। কিন্তু দাম এভাবে পড়ে যাবে ভাবতেও পারিনি। তিনি বলেন, সব চামড়া মাদ্রাসায় ফ্রি আসে বিষয়টি এমন নয়। আমরা মাদ্রাসা থেকে পশুর মালিকদের একটি ন্যূনতম দাম পরিশোধ করে চামড়া নিয়ে আসি। সেটি বিক্রি করে যে লাভ হয়, সেটি মাদ্রাসার কল্যাণে ছাত্রদের খাওয়া খরচ বা উন্নয়নে ব্যয় হয়। এ বছর অর্ধেকের মতো চামড়া খুবই কম দামে অনুরোধ করে বিক্রি করতে পেরেছি। আর বেশ কিছু চামড়া ফেলে দিতে হয়েছে।

একই বক্তব্য সিদ্ধিরগঞ্জের এনায়েতনগর হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার সভাপতি সুলতান মাহমুদেরও। তিনি বলেন, বিভিন্ন ব্যক্তির দান ছাড়াও কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ ও বিক্রির ওপর মাদ্রাসার আয় নির্ভরশীল। এ বছর চামড়ার দাম অস্বাভাবিক কম হওয়ায় মাদ্রাসার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না।

ঢাকার মতো একই অবস্থা চট্টগ্রামেও। রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি এবং উত্তর চট্টগ্রামের কয়েকটি উপজেলা থেকে সংগৃহীত চামড়া বিক্রির জন্য আনা হয়েছিল চট্টগ্রাম নগরীর আঁতুরার ডিপো এলাকায়। কিন্তু কাক্সিক্ষত দর না পেয়ে লক্ষাধিক চামড়া ফেলে চলে গেছেন ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া নগরীর বহদ্দারহাটসহ বিভিন্ন স্থানে জড়ো করা চামড়াও বিক্রি হয়নি। ফলে সেখানেও এখন পড়ে আছে চামড়ার স্তূপ। ফলে চামড়া বিক্রি করতে না পারায় হতাশ সব মাদ্রাসা ও এতিমখানা। আগামী এক বছর চট্টগ্রামের প্রায় পাঁচ শতাধিক মাদ্রাসা পড়–য়া এতিম ছাত্রের খরচ কীভাবে মেটানো যাবে তা নিয়েই চিন্তিত তারা।

হাটহাজারী উপজেলার পশ্চিম ধলই সফিনগর এলাকার তাহেরিয়া ছাবেরিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান, এবার তাদের এখানে দানের প্রায় ৮০০ চামড়া জমা হয়েছে। কিন্তু গতকাল বুধবার পর্যন্ত একটি চামড়াও বিক্রি হয়নি। অথচ এসব চামড়া পরিবহনসহ সংরক্ষণের পেছনে প্রায় ৭০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। এখন এই খরচ কীভাবে সমন্বয় করা যাবে, সেটি নিয়েই তারা চিন্তিত।

ফটিকছড়ির বাবুনগর আল জামেয়াতুল ইসলামিয়া আজিজুল উলুম মাদ্রাসার শিক্ষক ছালামত উল্লাহ জানান, কোরবানির চামড়া বিক্রি করে প্রতিবছর মিসকিন ফান্ডে ১৮-২০ লাখ টাকা আসত। গত বছর এই আয়ের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৯ লাখে। এই টাকা দিয়ে মাদ্রাসা পড়–য়া প্রায় ৭০০ এতিম ছাত্রের ব্যয় মেটানো হয়। এবার সাড়ে ১১০০ চামড়া পেলেও গতকাল পর্যন্ত এর একটিও বিক্রি হয়নি। ফলে মিসকিন ফান্ডে এক টাকাও জমা পড়েনি।

আঞ্জুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের অধীনে শতাধিক মাদ্রাসা পরিচালিত হয়। প্রত্যেক মাদ্রাসায় রয়েছে এতিমখানা। মিসকিন ফান্ডের টাকায় চলে এসব এতিমখানার কয়েক হাজার ছাত্রের লেখাপড়া। আগে কোরবানিতে চামড়া বিক্রি থেকে ১০ লাখ টাকার বেশি ফান্ডে জমা পড়ত। কিন্তু এবার কেউ চামড়া কিনছে না, ফলে মিসকিন ফান্ড শূন্য। উপরন্তু চামড়া সংগ্রহের খরচ নিজেদের বহন করতে হচ্ছে বলেও জানান ট্রাস্টের সিনিয়র সহসভাপতি মোহাম্মদ মহসিন।

Comment here