খরচের চাপে টান ভাতের হাঁড়িতে - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

খরচের চাপে টান ভাতের হাঁড়িতে

রেজাউল রেজা : আন্তর্জাতিক পণ্যবাজারের অস্থিরতায় দেশের বাজারে আমদানিনির্ভর নিত্যপণ্যের দাম একের পর এক বাড়ছেই। এরই মধ্যে দেশে উৎপাদিত চালের দামও এক হাত নিয়ে নিচ্ছে ভোক্তাদের। বাজারে অস্থিরতা কমাতে সরকার আমদানির সিদ্ধান্ত নিলেও সুখবর মিলছে না বাজারে। উল্টো জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার অজুহাতে সব ধরনের চালের দাম বাড়ানো হয়েছে।

দুই সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীর বাজারে সব ধরনের চালের দাম কেজিপ্রতি ২ থেকে ৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। নামিদামি ব্র্যান্ডের সরু চালের দাম আরও বাড়তি। এতে প্রতিদিনের খাবার পাতে ভাতের পেছনে খরচের চাপ বেড়ে গেছে, যা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে নিম্নআয়ের মানুষ। খেটে খাওয়া ও দরিদ্র অনেক পরিবার বাধ্য হচ্ছে ভাত খাওয়া কমিয়ে দিতে।

রাজধানীর কারওয়ানবাজারে চালের বস্তা বয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন দিনমজুর মো. সুরুজ আলী। দিনভর পিঠে চালের বস্তা বয়ে যে টাকা আয় হয়, তা দিয়ে চাল কিনে খেতে হিমশিম খেতে হয় খোদ সুরুজকেই। কথা হলে আক্ষেপ করে এমনটাই বলছিলেন তিনি। সুরুজ বলেন, কয়েকদিনের মধ্যে দাম যে হারে বাড়ছে তাতে চাউল কিনা খাইতে কষ্ট হইতাছে। ৪৮ টাকার নিচে এহন মোটা চাউলও পাওন যায় না। সারাদিন চালের বস্তা টানি, অথচ আমার নিজেরই ভাতের কষ্ট হইতেছে।

 

 

পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা চালের বস্তা টানা ভ্যানচালক মো. শরীফুদ্দিন সুরুজের কথায় তাল মেলান। তিনিও বলেন, আমরা গরিব মানুষ। দামি জিনিস এমনিতে কিনা খাইতে পারি না। দরকারও নাই। আমাগো কয়ডা চাউল হইলেই হয়। মরিচ দিয়া ডইলা খাইয়া দিন পার করতে পারি। কিন্তু চাউলের দামডাও বাড়লে আমগোর মহাবিপদ। যে টাকা কামাই, তাতে ভাত খাওনও কমাইয়া দিছি। আশায় আছি কবে দাম কমবো।

রাজধানীর বাজারে চালের দাম হঠাৎ বাড়তে থাকায় খেটে খাওয়া সুরুজ ও শরীফুদ্দিনের মতো কষ্টে আছে স্বল্প আয়ের পরিবারগুলো। করোনার অভিঘাতে এমনিতেই বিপর্যস্ত এসব জনগোষ্ঠী। এর মধ্যে জ্বালানির দাম বাড়ায় চাল, ডাল, তেলসহ সব পণ্যের দাম আরেক দফা বেড়েছে। নিত্যপণ্যের বাড়তি এ দামে নাকাল হতে হচ্ছে তাদের। কেবল নিম্নবিত্তরাই নয়, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তরাও চাল কেনা কমিয়ে দিয়েছেন বলে জানান চাল বিক্রেতারা। আগে যারা বস্তা হিসেবে চাল কিনতেন, তারা এখন ৫ কেজি, ১০ কেজি করে চাল কিনছেন।

রাজধানীর কদমতলী এলাকার সাদ্দাম মার্কেট বাজারের মিলন স্টোরের চাল বিক্রেতা মো. মিলন বলেন, সপ্তাহ দেড়েকের ব্যবধানে চালের বস্তায় (৫০ কেজি) ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। নামিদামি ব্র্যান্ডের সরু চালের বস্তায় বেড়েছে ৩০০ টাকা। আগে যেসব ক্রেতা বস্তা হিসেবে চাল কিনতেন- তাদের অনেকেই এখন ১০ কেজি, ৫ কেজি করে চাল কিনছেন। সরু চালের অনেক ক্রেতা এখন মাঝারি চাল কিনছেন।

মালিবাগ বাজারের মেসার্স বিপ্লব স্টোরের খুচরা ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সোলায়মান বলেন, আড়ত থেকেই আমাদের বাড়তি দামে বস্তা কিনতে হচ্ছে। তাই চলতি সপ্তাহে খুচরায় দাম বেড়েছে। আগে যে মিনিকেট ৬৮ টাকা কেজি বিক্রি করেছি, সেটা এখন ৭২ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। যে নাজিরশাইল ৭৫ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না- গত সপ্তাহের শুরুতেও নাজিরশাইল ৭০ টাকায় পাওয়া গেছে।

রাজধানীর একাধিক বাজারের খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অন্তত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে চালের দাম কেজিপ্রতি ২ থেকে ৪ টাকা বেড়েছে। কিছু ব্র্যান্ডের সরু চালের দাম ৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বেশিরভাগ দোকানে ৭০ টাকার নিচে মিলছে না সরু চাল। প্রতি কেজি বিআর-২৮ জাতের চাল আগে ৫৫-৫৬ টাকা কেজিতে পাওয়া গেলেও এখন তা ৫৮ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া দাম বেড়ে পাইজামের কেজি ৫৬ টাকা এবং স্বর্ণা (মোটা চাল) ৪৮ টাকা। কোথাও কোথাও বহুল প্রচলিত নুরজাহানের স্বর্ণা চাল ৫০ টাকা কেজিতেও বিক্রি হচ্ছে।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) সর্বশেষ (রবিবার) হিসাবও বলছে, সপ্তাহের ব্যবধানে সরু চালের কেজিতে ২ থেকে ১০ টাকা, মাঝারি চালের কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা এবং মোটা চালের কেজিতে ৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

এদিকে সরবরাহ বাড়িয়ে চালের বাজারে স্বস্তি আনতে আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আতপ ও সিদ্ধ- দুই ধরনের চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এর পরও বাজারে সুখবর মেলেনি।

ব্যবসায়ীরা জানান, ভারতের বাজারে চালের রপ্তানিমূল্য বৃদ্ধি এবং দেশে ডলারের দামে অস্থিতিশীলতার কারণে অনুমতি পেয়েও চাল আমদানির ঝুঁকি নিতে চাইছেন না আমদানিকারকরা। আমদানির সিদ্ধান্তে নতুন করে দাম না বাড়লেও অনেকটা সময় স্থিতিশীল ছিল চালের বাজার। সর্বশেষ জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার পর আবারও বাড়তে শুরু করেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খরচ বেড়েছে। তবে বস্তাপ্রতি দাম আরও বেশি বাড়িয়েছে আড়তগুলো। মূলত কিছু চতুর ব্যবসায়ী বেশি মুনাফার জন্য চালের দর নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। তাদের কারসাজিতেই দাম বেশি বাড়ছে।

কারওয়ানবাজারের মেসার্স রনি রাইস এজেন্সির ব্যবসায়ী মো. মনিরুল ইসলাম জনি আমাদের সময়কে বলেন, নানা অজুহাত ও টালবাহানাতে চালের দাম বাড়ছে। কারওয়ানবাজারের বেশির ভাগ চাল মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট থেকে আসে। সেখানে সকালে এক দাম থাকে, বিকালে আরেক দাম। এমনও হয় যে, ফোনে বুকিং দিয়ে আড়তে গেলে বলা হয় চাল নেই।

তিনি আরও বলেন, জ্বালানির দাম বাড়াতে বস্তাপ্রতি ৫০ থেকে ৭০ টাকা বাড়তে পারে। অথচ মোকামে ৩০০-৪০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। আগে আটাশ জাতের চালের বস্তা আমরা ২ হাজার ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকাতেও কিনতে পারতাম। এখন তা আমাদেরকেই কিনতে হচ্ছে ২ হাজার ৮০০ টাকা। একইভাবে সব চালের দাম বেড়েছে। দাম এত বাড়ায় বাধ্য হয়ে নতুন করে চাল কেনা বন্ধ রেখেছি।

 

Comment here