গাজীপুর প্রতিনিধি : সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মালিকানাধীন সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি চলছে অবৈধভাবে। গাজীপুরে অবস্থিত ৫০০ শয্যার এই হাসপাতালের কোনো অনুমোদনই নেই। প্রতিষ্ঠার প্রায় ছয় বছরেও সেখানে চিকিৎসার ন্যূনতম সুযোগ তৈরি করা হয়নি। এসব নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ এনে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল অভিযান চালিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
এছাড়া সেবা হাসপাতাল নামের আরও একটি হাসপাতালেও অভিযান চালানো জয়। গতকাল রোববার দুপুরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গঠিত টাস্কফোর্স র্যাবের সহায়তায় এ অভিযান পরিচালনা করেন। এসময় দুটি হাসপাতালকে ১১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম। অভিযানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্ম সচিব উম্মে সালমা তানজিয়া, র্যাব-১ এর পোড়াবাড়ি ক্যাম্প কমান্ডার আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
অভিযানে জানানো হয়, ওই হাসপাতালের যে ল্যাব রয়েছে তার অনুমোদন নেই। এছাড়া নানা অব্যবস্থাপনাসহ অপারেশন থিয়েটারে ব্যবহৃত মেয়াদোত্তীর্ণ সার্জিকেল সামগ্রী পাওয়া যায়। এছাড়া ল্যাব টেস্টের ক্ষেত্রে মেডিক্যাল শর্ত মানা হয়নি।
এ সময় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্মসচিব উম্মে সালমা তানজিয়া বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য এটা নয় কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা, সিলগালা করা। আমরা চাচ্ছি, আমাদের সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো সুষ্ঠু নিয়মে চলুক। আইনের মধ্যে থেকে সেবা নিশ্চিত করুক। আরও একটি বিষয় বলতে চাই, কিছুদিন আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা সেবা একটি চিটি দেয় যেটাতে মিডিয়ায় দেখেছি ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে । ’
তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিনিধি হিসেবে আমি এটা ক্লিয়ার করে বলতে চাই , কোনো অভিযান বন্ধ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। মিডিয়া বলেছে বন্ধ হয়ে যাবে কিন্তু আপনারা দেখেছেন অভিযান বন্ধ হয়নি। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঠিক রেখে এটা হচ্ছে সমন্বিতভাবে আরও জোরদার করা। সাধারণ মানুষ সেবা পেতে এসে যেন হ্যাম্পারের মধ্যে না পড়ে। এসময় তিনি সাংবাদিকদের কাছে তথ্য চেয়ে স্বাস্থ্য বিভাগকে ঢেলে সাজাতে সহযোগিতা কামনা করেন।’
তানজিয়া আরও বলেন, ‘এই হাসপাতালে কিছু সমস্যা পাওয়া গেছে সেজন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আসতে বলেছি। তারা আসলে যে অব্যবস্থাপনা গুলো পেয়েছি সেগুলো বলব। ’
অভিযান শেষে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, ‘সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটিতে যে অনিয়ম পেয়েছি তা অনাকাঙ্ক্ষিত। বিশেষ করে অপারেশন থিয়েটারে যে সার্জিকেল আইটেম ও ওষুধ পাওয়া গেছে সেগুলো ৫-৬ বছর আগে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এগুলো ব্যবহার করা হলে নানা রকম সমস্যা হতে পারে। এখানকার ডাক্তার এবং আমাদের সঙ্গের ডাক্তারাও মত দিয়েছেন এটি কাঙ্ক্ষিত নয়। এছাড়া এখানে যে প্যাথলজিকেল ল্যাব রয়েছে সেখানে কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়া ব্লাড ট্রান্সমিশন করা হচ্ছে। রক্ত পরিসঞ্চালন করতে গেলে রক্ত পরিসঞ্চালন আইন অনুযায়ী লাইসেন্স নিতে হয়। কিন্তু এদের কোনো লাইসেন্স নেই, লাইসেন্স ছাড়াই রক্ত পরিসঞ্চালন করেছে। এখানে যে ব্লাড কালচার করা হচ্ছে তা মানুষের কাছ থেকে নেওয়া যদিও এগুলো শিপ থেকে নেওয়ার কথা। এতে ভুল রিপোর্ট আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া হাসপাতালটি কোনো লাইসেন্স নেই। যেহেতু মন্ত্রণালয় ২৩ আগস্ট পর্যন্ত লাইসেন্স নবায়নের সুযোগ দিয়েছে সেকারণে প্রতিষ্ঠানটি এখন সিলগালা করছি না। এই সময়ে লাইসেন্স নিতে ব্যর্থ হলে আমরা অবশ্যই এটি বন্ধ করে দিব। আমরা চাই আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো চলুক, যারা ভালো চালাবেন তাদের আমরা ধন্যবাদ দিব। ’
তিনি বলেন, ‘আমরা চাই রোগীরা যেন প্রতারণা ও ভুল রিপোর্ট ছাড়া ভাল চিকিৎসা পান। আমরা মনে করি সবাই সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করলে আমরা হয়তো এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারব।’
পরে হাসপাতালটির অব্যবস্থাপনা ও মেয়াদোত্তীর্ণ সার্জিকাল সামগ্রী ব্যবহার করায় সাড়ে ৭ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দীন আলমগীর হাসপাতালটির চেয়ারম্যান এই বিষয় নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সারোয়ার আলম আরও বলেন, ‘ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পরিচয় দিয়ে না বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী আইন সবার জন্য সমান। সুতরাং আমি যদি কোনো অন্যায় বা অপরাধ করি, আমি সরকারের কোনো দায়িত্বে আছি বা ম্যাজিস্ট্রেট আছি বলে আলাদা কোনো বিধান নেই। এক্ষেত্রে সবাই সমান। তবে আমরা সম্মান করি যারা দায়িত্বশীল তারা দায়িত্বশীল আচরণ করবেন। দায়িত্বশীলরা খারাপ আচরণ করলে সাধারণ মানুষ কষ্ট পাবে। নিয়ম সবার জন্য সমান। দায়িত্বশীলরা যদি দায়িত্বশীল আচরণ না করে সাধারণ মানুষ শিখবে কোত্থেকে। কে মালিক, কে পরিচালক এটি আমাদের দেখার বিষয় নয়, আমরা চাই প্রতিষ্ঠান ভাল চলুক।’
তিনি হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা বিষয়ে হুশিয়ারী দিয়ে বলেন, ‘২৩ আগস্টের মধ্যে অনুমোদন হীন হাসপাতালগুলো লাইসেন্স নিতে ব্যর্থ হলে সেই প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হব। কারণ স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে প্রতারণা বা ছিনিমিনি করা হোক তা কোনোভাবেই বরদাশত করা হবে না।’
রোববার দুপুর ১টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত অভিযানে ভ্রাম্যমাণ আদালতের টিম অপারেশন থিয়েটার, ফার্মেসি, প্যাথলজিক্যাল ল্যাব পরিদর্শন করেন, কাগজপত্র যাচাই বাছাই করেন।
অভিযানের বিষয়ে সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ ডা. ইউনুছ আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি লাইসেন্সের বিষয়টি কর্তৃপক্ষের উল্লেখ করে এ বিষয়ে আর কোনো ধরনের মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এদিকে, অপারেশন থিয়েটারে মেয়াদোত্তীর্ণ মালামাল ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগে সেবা হাসপাতালকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
Comment here