সারাদেশ

‘চক্রান্তে পড়ে’ চাকরি হারাচ্ছেন ব্যাংকাররা

জিয়াদুল ইসলাম : আ. ন. ম. মুঈজ আহম্মেদ। সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের ইন্টারন্যাশনাল ডিভিশনের প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। থাকেন রাজধানীর আফতাবনগরে ব্যাংকের ঋণে কেনা একটি ফ্ল্যাটে। ব্যাংক থেকে গাড়ির সুবিধাও পেতেন। ফলে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে সুখেই সংসার চলছিল। কিন্তু ব্যাংক পর্ষদের চেয়ারম্যান পরিবর্তন হওয়ার পর দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকে। সাবেক চেয়ারম্যানের হয়ে কাজ করেছেন- এমন অভিযোগে গত মার্চে তাকে বরখাস্ত করা হয়। অথচ কিছুদিন আগেও তিনি দক্ষ কর্মকর্তা ও ভালোর দৃষ্টান্ত ছিলেন। এখন চরম অনিশ্চয়তায় তার দিন কাটছে। মুঈজ আহম্মেদ ভেবেছিলেন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ অন্তত ছাড়পত্র দেবেন। এই আশায় অন্য একটি ব্যাংকে চাকরির জন্য সাক্ষাৎকার দেন। এরপর ‘ইন্টারন্যাশনাল ডিভিশনের’ প্রধান হিসেবে ‘অফার লেটারও’ পান। কিন্তু সাউথ বাংলা ব্যাংক তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ায় সে সুযোগও হাতছাড়ার পথে। এখন গ্রামে ফিরে যাওয়া ছাড়া তার আর কোনো উপায় দেখছেন না তিনি। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি অভিযোগ জানিয়েছেন মুঈজ আহম্মেদ।

ব্যাংকগুলোতে অন্যায়ভাবে কর্মীদের চাকরিচ্যুতি করার ঘটনা বেড়েই চলছে। কর্মকর্তাদের সুরক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার তোয়াক্কা করছে না ব্যাংকগুলো। অপছন্দের কর্মকর্তাকে কোনো ঘটনায় ফাঁসিয়ে দিয়ে দীর্ঘমেয়াদে সংকটে ফেলা হচ্ছে। শীর্ষ নেতৃত্বের পরিবর্তনেরর সঙ্গে সঙ্গেই চাকরিচ্যুতির ঘটনা বেশি ঘটছে। সম্প্রতি এনআরবি ব্যাংকেও অনেক নিরপরাধ কর্মকর্তাকে ফাঁসানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের স্বপদে পুনর্বহালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনাও পরিপালন করেনি ব্যাংকটি। এভাবে তীর্থের কাকের মতো চাকরি ফিরে পেতে ব্যাংকারদের হাহাকার বেড়েই চলেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, করোনার মধ্যেই কর্মীদের বেশি চাকরিচ্যুত করার ঘটনা ঘটেছে। ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত ছয়টি ব্যাংকে তিন হাজার ৩১৩ জন কর্মী চাকরি ছেড়েছেন। এর মধ্যে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন ৩ হাজার ৭০ জন। এ ছাড়া ১২ কর্মীকে ছাঁটাই, ২০১ কর্মীকে অপসারণ ও ৩০ কর্মীকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

ব্যাংক কর্মকর্তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে সম্প্রতি কয়েকটি ব্যাংক পরিদর্শন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিস ডিপার্টমেন্ট। এতে অনেক ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রমাণ না থাকার পরও চাকরিচ্যুতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে অনেককে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুনরায় নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশনা দিলেও ব্যাংকগুলো তা পরিপালন করছে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা যায়, এনআরবি ব্যাংকের শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনায় এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না থাকা সত্ত্বেও তৎকালীন কোম্পানি সেক্রেটারি মো. হাসানুল হককে বিধিবহির্ভূতভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়। শেয়ার ট্রেডিংয়ে তার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। তিনি ইনভেস্টমেন্ট কমিটির সদস্যও ছিলেন না। ব্যাংকের অননুমোদিত শেয়ার ট্রেডিংয়ের বিষয়ে বহিঃনিরীক্ষকের নিরপেক্ষ নিরীক্ষায়ও তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উত্থাপন করা হয়নি। তারপরও ব্যাংক কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়া নির্ধারিত প্রক্রিয়া ছাড়াই হাসানুল হককে চাকরিচ্যুত করে। ব্যাংকিং খাতের সুশাসন রক্ষায় হাসানুল হককে চাকরিতে পুনর্বহালের নির্দেশনা দেওয়া হয় এবং ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মামুন মাহমুদ শাহকে সতর্ক করা হয়। তারপরও হাসানুল হককে চাকরিতে পুনর্বহাল করেনি ব্যাংকটি।

এ বিষয়ে এনআরবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন মাহমুদ শাহের বক্তব্য জানতে মোবাইলে ফোন দিলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে ব্যাংকটির জনসংযোগ বিভাগের মাধ্যমে জানা যায়, তিনি দেশের বাইরে আছেন। তার অবর্তমানে এমডি হিসেবে চলতি দায়িত্ব পালন করছেন ব্যাংকটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাকির আমিন চৌধুরী। তবে বিষয়টি নিয়ে শাকির আমিন কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, আমরা যে সার্কুলার দিয়েছি, তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো কর্মীকে চাকরিচ্যুত করা হলে বা কোনো কর্মকর্তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হলে অবশ্যই সেই কর্মকর্তাকে পুনর্বহাল করতে হবে। কোনো ব্যাংক আমাদের নির্দেশনা না মানলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাউথ-বাংলা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান পরিবর্তনের পর থেকে গত ছয় মাসে মোট কর্মকর্তার ৬০ ভাগকে বদলি করা হয়েছে। পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে ২০ জনকে। চাকরিচ্যুত হয়েছেনও কয়েকজন। বেশির ভাগ ঘটনায় নিয়ম মানা হয়নি। নারী কর্মকর্তাদের স্থানান্তরেও চরম অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে ব্যাংকটি। অনেক কর্মকর্তা চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।

আ.ন.ম. মুঈজ আহম্মেদ আমাদের সময়কে বলেন, ব্যাংকের চেয়ারম্যান পরিবর্তন হওয়ায় চরম রোষানলে পড়েছেন তিনি। একটি শাখার কিছু অনিয়মের সঙ্গে তাকে অযৌক্তিক ও অন্যায়ভাবে জড়ানো হয়। তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ খ-ন করেও লাভ হয়নি। দুই উপব্যবস্থাপনা পরিচালককেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তাদের পদত্যাগের ‘রিলিজ লেটার’ দেওয়া হলেও মুঈজকে দেওয়া হয়নি।

এই ব্যাংকের লিগ্যাল অ্যান্ড রিকভারি ডিভিশনের ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সুলতানা রাজিয়াও জোরপূর্বক পদত্যাগের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অভিযোগ করেছেন। তাকে আগে নিষ্পত্তিকৃত একটি ঘটনায় ফাঁসানো হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। এমনকি তাকে বোর্ডসভায় ডেকে জেরা করে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে সাউথ-বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘যে কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন ছাড়াই সাবেক চেয়ারম্যানের ৩৪৭ কোটি টাকার বেশি এলসি খোলার অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে দুদক থেকেও মামলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও বিষয়টি তদন্ত হচ্ছে। তাই এসব তদান্তাধীন বিষয়ে আমার মন্তব্য করা ঠিক হবে না।’

 

Comment here

Facebook Share