ওসমান গনি : নদী, পাথর, পাহাড়, জলপ্রপাত আর চা বাগান- এসবের সমন্বয়ে গঠিত হলো সিলেট। কী অপূর্ব সৌন্দর্য সিলেট জেলা! আর এই সিলেটের অর্থকরী ফসলের মধ্যে একটি হলো চাপাতা। সিলেট মানেই যেন চা বাগান এবং চা বাগানের নারী শ্রমিকদের চা তোলার চিত্র। আমাদের দেশের অর্থনীতিতে চাশিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। এর মূল শক্তি চা শ্রমিক ও কর্মচারীরা। তাদের শ্রমেই এ শিল্পের মালিকদের বড় বড় অট্টালিকা আর অভিজাত জৌলুস গড়ে উঠেছে।
পরিত্যক্ত জমি নিজের শ্রম ও ঘাম দিয়ে আবাদ করে মূল্যবান চা উৎপাদন করে যাচ্ছেন চা শ্রমিকরা। তাদের চা পৃথিবীর ২৫টি দেশে রপ্তানি করা হয়। কিন্তু চা শ্রমিকরা সব নাগরিক সুবিধা ভোগের অধিকার সমভাবে প্রাপ্য হলেও পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বৈষম্যের শিকার বলে প্রতীয়মান। চা বাগানের প্রত্যেক নারী শ্রমিকই চান, তারা নানা কষ্টে নিজেদের জীবনকে পার করলেও তাদের সন্তানরা যাতে সুখ নামের সোনার হরিণটিকে ছুঁতে পারে; তারা লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হয়ে দেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করতে পারে। কিন্তু চায়ের দেশে পর্যাপ্ত স্কুল ও চা শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার না থাকায় তাদের ওই স্বপ্ন বোধহয় চা বাগানের অন্ধকারে।
১৮৫৪ সালে সিলেটের মালিনীছড়া চা বাগান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে চায়ের আবাদ শুরু হয়। ব্রিটিশ কোম্পানি একের পর এক চা বাগান প্রতিষ্ঠা করলে প্রয়োজন হয় শ্রমিক সংগ্রহের। আসাম, নাগাল্যান্ড, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, উড়িষ্যা, মাদ্রাজ বিহার প্রভৃতি অঞ্চলের নিম্নবর্ণের হাজারো মানুষকে মিথ্যা স্বপ্ন ও উন্নত জীবনের আশ্বাস দিয়ে এসব চা বাগানে নিয়ে আসা হয়। এসব মানুষ যেখানে এসেছিল একটু উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে, সেখানে এসে চিত্রপট দেখে সম্পূর্ণই ভিন্ন। কোম্পানি মালিকরা এসব শ্রমিককে গহিন জঙ্গল কেটে বাগান তৈরি করার কাজে নিয়োজিত করে নামেমাত্র মজুরিতে। সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনিতে একবেলা খাবারও জুটত না অনেক সময়। ফলে অনাহার-অর্ধাহারে জীবন পার করতেন শ্রমিকরা। একদিকে খাবার ও বাসস্থানের সংকট, অন্যদিকে বাগান মালিকদের নির্যাতন-নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে থাকে চা বাগানে নিয়োজিত শ্রমিকদের জীবন। এ রকম অসহনীয় পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে মালিক শ্রেণির শোষণ, বঞ্চনা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন চরাঞ্চলের চা শ্রমিকরা।
১৯২১ সালে ৩ মার্চ সিলেট ও এর আশপাশের প্রায় ৩০ হাজার চা শ্রমিক ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাগান ছেড়ে নিজ মুল্লুকে ফিরে যাওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। ‘মুল্লুক চলো’ অর্থাৎ নিজ ভূমিতে চলো। তাদের দাবি ছিল, ইংরেজদের অধীন কাজ করবেন না এবং তাদের নিজেদের ভূমিতে ফিরে যাবেন।
উল্লেখ্য, ওই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন প-িত দেওশরন ও প-িত গঙ্গা দয়াল দীক্ষিত। জাতি-ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই প্রজাতন্ত্রের নাগরিক। এখানে কোনো জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করা চলবে না। চা বাগানে শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চবিদ্যালয়, কারিগরি বিদ্যালয়, কলেজ প্রতিষ্ঠা ও চা বাগানের ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিশেষ শিক্ষাবৃত্তির প্রচলন করা উচিত। চা বাগান এলাকায় পর্যাপ্ত সরকারি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে চা শ্রমিকদের বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের মানুষ মনে করলে এসব অবশ্যই করতে হবে।
নারী শ্রমিকরা চা বাগানের অভ্যন্তরে ও বাইরে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করলেও জানেন না নারী অধিকারের কথা। এসব নারী চা শ্রমিক এই শিল্পে অবদান রাখলেও বরাবরই অধিকার থেকে বঞ্চিত।
ওসমান গনি : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
Comment here