যশোর প্রতিনিধি : তিন বৃদ্ধকে কান ধরিয়ে ছবি তুলে দেশজুড়ে আলোচনায় এসেছেন যশোরের মণিরামপুরের সহকারী কমিশনার, ভূমি (এসি ল্যান্ড) সাইয়েমা হাসান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে আজ শনিবার তাকে সেই পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ওই তিন বৃদ্ধ আজ কথা বলেছেন আমাদের সময়’র এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। মনিরামপুরের শ্যামকুড় গ্রামের ভুক্তভোগী এক ভ্যানচালক জানান, পায়ে চালানো ভ্যানে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। অভাব-অনটনের সংসারে তার রয়েছে একটি মাটির ঘর। এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এখন এক ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে দিনে এনে দিনে খান।
গতকালের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ওই ভ্যানচালক জানান, করোনাভাইরাস সচেতনতায় এলাকায় প্রশাসনের মাইকিং ও পুলিশ টহল দেখে গত তিনদিন ভ্যান চালাতে বের হননি তিনি। কিন্তু টানপোড়েনের সংসারে রান্নার চাল-তরকারি কেনার জন্যই সামান্য রোজগার করতে গতকাল শুক্রবার ভ্যান নিয়ে বের হয় তিনি। ভ্যান চালিয়ে কিছু টাকা আয় করেন। পরে কেনাকাটা করতে চিনাঢোলা বাজারে যান।
ওই ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ আরও জানান, এরই মধ্যে এসি ল্যান্ড সাইয়েমা হাসানের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত জনসম্মুখেই ‘তুই-তুকারি’ কথা বলে কান ধরতে বলেন। এতে অসাহায় হওয়া সত্ত্বেও তিনি কান ধরে দাঁড়িয়ে যান। পরে সেটির ভিডিও করেন ও ছবি তোলেন এসি ল্যান্ড।
ওই ভ্যানচালক বলেন, ‘বাড়ি ফিরে এ লজ্জার কথা কাউকে জানাতে পারিনি। মেয়ে-জামাই আছে, প্রতিবেশী, ছেলে-স্ত্রী তাদেরকে কীভাবে এ লজ্জার কথা বলব? এ জন্যই কাউকে কিছু বলিনি, বিচার দিয়েছি আল্লাহর কাছে।’
পাশের দক্ষিণ লাউড়ি গ্রামে গিয়ে কথা হয় এসি ল্যান্ডের নির্দেশে ‘কান ধর‘ ভুক্তভোগী আরেকজনের সঙ্গে। স্থানীয় বাজারের এই তরকারি বিক্রেতা জানান, প্রতি দিন বিকেলে অল্প কিছু তরকারি নিয়ে ফুটপাতের বসে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। সামান্য আয়ের টাকায় চার মেয়ে-এক ছেলেকে বড় করেছেন।
একই গ্রামের আরেক ভুক্তভোগী মাঠের আয়ে কোনো রকমে সংসার চালান। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে এক ছেলে-স্ত্রীকে নিয়ে গরিব হলেও সন্মানের সঙ্গে বেঁচে আছেন তিনি।
ভুক্তভোগী দোকানী বলেন, ‘এসি ল্যান্ড স্যার আমাদের নাতির বয়সী। তিনি কোনো কিছু না জেনেই লোকজনের মধ্যেই আমাদের কান ধরে দাঁড়াতে বাধ্য করলেন। জীবনে আমরা কেউ এমন অপমানিত হয়নি। শুধু তাই নই, এ ঘটনা মেয়ের জামাই-আত্মীয়স্বজন জানলে তাদের সামনে যাওয়ার পরিস্থিতি কি থাকবে? জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এমন পরিস্থিতিতে পড়ব এটা ভাবিনি।’
এই বৃদ্ধ আরও বলেন, ‘তবুও আমরা অপরাধী, আল্লাহ আমাদের অপরাধ দেখেছেন… তিনি যেন বিচার করেন।’
ওই ঘটনা সম্পর্কে স্থানীরা জানান, দেশের পরিস্থিতিতে সরকারি নির্দেশনা না মেনে মাস্ক না পরে বাইরে এসে অবশ্যই তিন বৃদ্ধ ঠিক করেননি। কিন্তু গ্রামের খেটে খাওয়া বাবার বয়সী এসব লোকদের জনসম্মুখে এভাবে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে ছবি তোলা, একজন সরকারি কর্মকর্তা এটা করতে পারেন না। সভ্য দেশে একজন সরকারি গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা কোন মানসিকতায় এমনটি করলেন? তার এই কাজের কি বিচার হবে?
ক্ষমা চাইলেন এসি ল্যান্ড
গতকালের সেই ঘটনার জন্য অবশেষে ক্ষমা চেয়েছেন প্রত্যাহার হওয়া এসি ল্যান্ড সাইয়েমা হাসান। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে সাইয়েমা হাসান বলেন, ‘শুক্রবার বিকেলে বাজার মনিটরিং ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতকরণের জন্য অভিযানে বের হই। এ সময় চেষ্টা করি বাজারে মানুষজনের জমায়েত দূর করার এবং তাদের বিশেষ কাজ ছাড়া বাজারে ভিড় করতে নিষেধ করি। যারা মাস্ক পরেনি তাদের জিজ্ঞেস করছিলাম, মাস্ক কেন পড়েনি? এই সময়ে উক্ত ছবির আলোচিত ব্যক্তিরাও ওখানে ছিল।’
সাইয়েমা বলেন, ‘সে মাস্ক কেন পরেনি জিজ্ঞাসা করতেই তারা নিজেরাই ভয়ে কান ধরেছে, কাল থেকে মাস্ক ছাড়া বের হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই সময় আমি ছবি তুলতে তুলতে বললাম যে, আমি গতকালও এখানে এসে অনেককে বলেছি, কিন্তু আজও এরকম দেখছি। এই যে আপনাদের আজ ছবি তুলে রাখছি, আবার দেখলে কিন্তু শাস্তি দেব।’
সাইয়েমা হাসান আরও বলেন, ‘এই ছবিগুলো ফেসবুকে যেভাবে এসেছে, এই ধরনের কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না। ওই মুহূর্তে আমি ঠিক এর তীব্রতা বুঝতে না পারলেও পরবর্তীতে আমার ভুল বুঝতে পারি। আমি স্বীকার করছি আমার কাজটা করা ঠিক হয়নি, আমি মন থেকে এর জন্য অনুতপ্ত। আমি অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি।’
বাড়ি নির্মাণ করে দিতে চাইলেন ইউএনও
আজ বেলা ১২টার দিকে ওই বৃদ্ধের বাড়িতে যান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আহসান উল্লাহ শরিফী। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন মণিরামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম ও স্থানীয় শ্যামকুড় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান মনি। পরে ইউএনও বলেন, ‘আমি তাদের বাড়িতে গিয়ে বিষয়টি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছি। তাদের হাত ধরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়েছি। আমি তাদের সার্বিক সহযোগিতাসহ ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছি।’
ইউপি চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান মনি জানান, গতকাল বিকেলে মাস্ক না পরে চিনাটোলা বাজারে যাওয়ায় শ্যামপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ লাউড়ি গ্রামের তরকারি বিক্রেতা, একই গ্রামের এক ভ্যানচালক দিনমজুর ও দক্ষিণ শ্যামকুড় গ্রামের আরেক ভ্যানচালককে কান ধরিয়ে লাঞ্ছিত করেন এসি ল্যান্ড সাইয়েমা হাসান। শুধু তাই নয়, নিজের মুঠোফো বৃদ্ধদের ছবিও তোলেন এসি ল্যান্ড। সেই ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।
Comment here