জুয়ার আসর ঘিরে ‘উত্তপ্ত’ পল্লবী - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
ঢাকাসমগ্র বাংলা

জুয়ার আসর ঘিরে ‘উত্তপ্ত’ পল্লবী

ইউসুফ সোহেল : রাজধানীর পল্লবীতে পাড়া-মহল্লায় চলছে জমজমাট জুয়ার আসর। তিন তাস, কাইট, হাজারী, কেরাম, লুডু ও আইপিএলসহ বিভিন্ন আইটেমের আসরে প্রতিদিনই ওড়ে লাখ লাখ টাকা। বস্তির খুপড়ি ছাড়াও কয়েকটি ক্লাব, মার্কেট, দোকান, রিকশার গ্যারেজ ও পরিত্যক্ত ভবনে চলে এসব অবৈধ কারবার। তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী, পেশাদার ছিনতাইকারী, এলাকার মাস্তান, ছিঁচকে চোর থেকে শুরু করে জুয়ার আখড়ায় অংশ নেয় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। বাদ যান না দিনমজুর কিংবা রিকশাচালকরাও। হাতেগোনা কয়েকজন লাভবান হলেও ভয়ঙ্কর এ নেশার টানে সর্বস্ব হারাচ্ছেন বাকিরা।

জানা গেছে, পল্লবীর মিরপুর ১০-এর ৩ নম্বর ওয়ার্ড, মিরপুর-১১ নম্বর বি ব্লক, মিরপুর সাড়ে-১১, মিরপুর ৬-এর ট-ব্লক, পল্লবীর ১২-ই ও ১২-ডিসহ এই থানা এলাকার ১৪টি স্পটে চলে জুয়ার কারবার। গাদাগাদি করে ২০ থেকে ২৫ জুয়াড়ি প্রতিনিয়ত দল বেঁধে জুয়া খেলে, যাদের বেশির ভাগই তরুণ। বিভিন্ন আইটেমের খেলায় সর্বনিম্ন ৫শ থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বাজি ধরা হয়। প্রকারভেদে একেকটি স্পটে প্রতিদিন ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকার জুয়া চলে। আর জুয়ার টাকা ম্যানেজ করতে গিয়ে অনেকে আবার ছিনতাইয়ের মতো ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এ নিয়ে অভিভাবকরাও উদ্বিগ্ন। কিন্তু স্থানীয় সন্ত্রাসী ও চিহ্নিত মাদকব্যবসায়ীরা আখড়াগুলোর মালিক হওয়ায় তাদের ভয়ে প্রতিবাদ করার সাহস পান না স্থানীয়রা। এতে পারিবারিক অশান্তিসহ সমাজে নানা ধরনের অসঙ্গতি বাড়ছে। ভুক্তভোগীরা সর্বস্বান্ত হলেও জুয়ার নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে আয়োজক চক্র। আইনানুযায়ী দ-নীয় অপরাধ হলেও অভিযোগ রয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যকে ম্যানেজ করেই দিনের পর দিন চলছে এসব অবৈধ কর্মকা-।

অভিযোগ উঠেছে, পুলিশের দুর্বল নজরদারির কারণে কোনো কোনো জুয়ার আসরকে ঘিরে গড়ে উঠেছে মাদকের স্পট। নির্বিঘ্নে চলছে মাদক সেবন ও বেচাকেনা। এতে করে জুয়া-নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে উঠতি বয়সীরাও। এতে সর্বস্ব হারানো ছাড়াও জুয়ার বিরোধকে কেন্দ্র করে প্রায়ই ঘটছে হাতিহাতি, মারামারি ও রক্তপাতের ঘটনা। সর্বশেষ গত সোমবার রাতে পল্লবীর ১২ নম্বর সেকশনের ঘাটিপাড়া বস্তির জামালের জুয়ার স্পটে মারামারি হয়। মূলত স্থানীয় প্রতিবাদী যুবকরা জুয়ার ওই স্পটটি বন্ধ করতে গেলে জুয়াড়িদের সঙ্গে প্রথমে কথা কাটাকাটি পরে সংঘর্ষ বাঁধে। এক সময় জুয়াড়িদের পক্ষে অবস্থান নেন স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কথিত নেতাকর্মীরা। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মো. বাবু নামে প্রতিবাদী এক যুবককে পরে রাস্তায় একা পেয়ে হত্যার চেষ্টা চালায় জুয়াড়িরা। গত বুধবার হত্যাচেষ্টা, ছিনতাইসহ কয়েকটি অভিযোগ এনে ছয়জনের বিরুদ্ধে পল্লবী থানায় মামলা (নম্বর-৮৭) করেন ভুক্তভোগী বাবু। আসামিরা হলেন- পল্লবীর ১২ নম্বর সেকশনের বাসিন্দা মো. সুমন, রনি, জামাল, রুবেল, জাকির ও মো. আলানি। ওই মামলার একদিন পরই বাবুসহ চারজনের নাম উল্লেখ উল্টো মামলা ((নম্বর-৮৯) করেন আসামি রনির স্ত্রী শিরিন বেগম। ওই মামলার অভিযোগ আরও শক্ত- হত্যাচেষ্টার সঙ্গে শ্লীলতাহানি! বাবু ছাড়াও এজাহারভুক্ত আসামিরা হলেন- পল্লবীর ১২ নম্বর সেকশনের বাসিন্দা শাহিন, টিটু ও আল আমিন।

বাদী শিরিন বেগমের অভিযোগ, আসামিরা তার বাড়ির পাশে আড্ডাবাজি ও তরুণীদের উত্ত্যক্ত করতেন। এতে বাধা দেওয়ায় তার ওপর হামলা চালান আসামিরা। আর আগের মামলার বাদী বাবুর অভিযোগ, জুয়ার স্পট বন্ধ করে দেওয়ায় চিহ্নিত জুয়াড়িরা তার ওপর হামলা চালিয়েছে। এখন আসামির স্ত্রীকে দিয়ে মিথ্যা মামলা সাজিয়ে পুলিশি নাজেহালের চেষ্টা করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বড় ক্ষতি করতে আসামিরা তার বাড়ির চারপাশে ঘোরাঘুরি করছে। মামলা তুলে না নিলে পরিবারের অন্য সদস্যদেরকেও মামলা দিয়ে ফাঁসানো হবে বলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। গতকাল শনিবার রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পুলিশ দুই মামলার একজন আসামিকেও গ্রেপ্তার করতে পারেনি। উল্টো এলাকায় মুখোমুখি অবস্থানে দুপক্ষ। এতে করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

মো. বাবু জানান, পল্লবীর ঘাটিপাড়া বস্তিতে জামালের বাসায় দীর্ঘদিন ধরে জুয়ার স্পট চলছিল। নারীঘটিত অনৈতিক কার্যকলাপও হতো এখানে। এটা এলাকার সবারই জানা। চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা ছাড়াও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, এমনকি নিম্নআয়ের পেশাজীবীরা এখানে জুয়া খেলতে এসে সর্বস্ব খুইয়ে খালি হাতে ফিরে যেত। এ ধরনের বেশকিছু অভিযোগ পেয়ে জুয়ার স্পটটি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন স্থানীয় কয়েকজন। এর মধ্যে বাবুও রয়েছেন। গত সোমবার রাত ১০টার দিকে স্থানীয়রা জুয়ার স্পটটি বন্ধের জন্য জামালকে অনুরোধ জানায়। এতে জামাল ও তার সহযোগীরা ক্ষেপে গিয়ে প্রতিবাদী যুবকদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় জড়ায়। যদিও স্থানীয়দের প্রতিবাদের মুখে স্পটটি বন্ধ করতে বাধ্য হয় জুয়াড়িরা।

এ ঘটনার জের ধরেই রাত সাড়ে ১১টার দিকে সিরামিক রোড চান্দারটেক এলাকায় জুয়াড়ি সুমন ও জামাল তাদের ক্যাডার বাহিনী নিয়ে বাবুর ওপর হামলা চালায়। তাদের এলোপাতাড়ি মারধরে রক্তাক্ত জখম হন তিনি। পরে গুরুতর অবস্থায় বাবুকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করে স্থানীয়রা। হত্যার চেষ্টা করেই ক্ষান্ত হয়নি আসামিরা। আর যেন কেউ জুয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে সাহস না পায়, সে জন্য তারা প্রথমে এক নারী দিয়ে প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে সাজানো মিথ্যা মামলা দায়েরের চেষ্টা করে। কিন্তু কাজ না হওয়ায় পরে আসামি রনির স্ত্রীকে দিয়ে মিথ্যা মামলা করানো হয়। এমনকি হামলাকারীরা প্রকাশ্যেই ঘোরাঘুরি করছে এলাকায়। তাই নিজেকে এবং পরিবারের সদস্যদের নিয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলেও জানান আহত বাবু।

এদিকে বাবুর মামলার দুই নম্বর আসামি মো. রনি বলেন, ‘আমরা কেউই বাবু বা অন্যদের মারধর করিনি। উল্টো ওরাই আমার স্ত্রীকে মারধর করেছে।’ ওই ঘটনায় তার স্ত্রী শিরিন বেগম নিজেই বাদী হয়ে পল্লবী থানায় মামলা করেছেন বলে জানিয়েছেন রনি। তবে জুয়ার স্পটের বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি এই যুবক। শিরিন তার এজাহারে উল্লেখ করেন, তিনি সপরিবারে পল্লবীর ১২ নম্বর সেকশনের উত্তর কালশী হিন্দুপাড়া বস্তিতে বসবাস করেন। আসামি শাহিন তার বাসার গলিতে প্রায়ই আড্ডা মারেন এবং পথচারী মেয়েদের বিভিন্ন সময়ে উত্ত্যক্ত করেন। এতে প্রতিবাদ করায় গত সোমবার রাত ১০টার দিকে অভিযুক্ত শাহিন, টিটু, বাবু, আল আমিনসহ অচেনা আরও তিন থেকে চারজন তার বাসায় ঢুকে হামলা চালায় এবং তাকে শ্লীলতাহানি করে। তাদের এলোপাতাড়ি মারপিটে রক্তাক্ত জখম হন বাদী ও তার পরিবারের সদস্যরা। শিরিন স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন এজাহারে।

দুটি মামলারই তদন্তকারী কর্মকর্তা পল্লবী থানার এসআই মাহমুদুল হাসান। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘উভয়পক্ষের আসামিদের রক্ত গরম। তাই সামান্য মারামারির ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে। মামলা দুটির তদন্ত চলছে। পাশাপাশি আসামিদের গ্রেপ্তারেরও চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’ এ ঘটনা নিয়ে নতুন করে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে দেওয়া হবে না বলেও হুশিয়ারি দেন পুলিশ কর্মকর্তা মাহমুদ।

 

Comment here