জ্বালানি সংকট তীব্র হচ্ছে - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

জ্বালানি সংকট তীব্র হচ্ছে

এক দশক ধরে দেশে জ্বালানি সংকট চলে এলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা আরও প্রকট আকার ধারণ করছে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে একদিকে নতুন বিনিয়োগ, শিল্প স্থাপন ও কল-কারখানার সম্প্রসারণ থমকে আছে। আরেক দিকে বিদ্যমান শিল্প উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সংকুচিত হচ্ছে কর্মসংস্থান। মূলত গ্যাসের অভাবে শিল্প খাত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছে না। দেশে প্রতিদিন চাহিদার চেয়ে মাত্র অর্ধেকের চেয়েও কম গ্যাস সরবরাহ করে সরকার। এই সংকটের প্রধান কারণ অব্যাহতভাবে অভ্যন্তরীণ গ্যাস উৎপাদন কমে যাওয়া এবং চাহিদা অনুযায়ী এলএনজি আমদানি করতে না পারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি বছর দেশীয় উৎসে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন কমে এলেও এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন কূপ খনন ও অনুসন্ধান হচ্ছে না। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও আমদানি সক্ষমতার বাড়াতে না পারার পেছনে ধীরগতিই প্রধান সমস্যা।

দেশের জ্বালানি চাহিদা দ্রুত সমাধানের কোনো পথ নেই জ্বালানি বিভাগের কাছে। গতানুগতিক পথেই সমাধানের চেষ্টা চলছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সরকার সংকট সমাধানে চেষ্টা করছে, তবে সময়সাপেক্ষ। ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতিযোগিতামূলক বিশে^ জ¦ালানি সংকট বাংলাদেশকে অনেক পিছিয়ে দেবে। অর্থনীতির চাকা থামিয়ে দেবে। স্থবিরতা তৈরি করবে বিনিয়োগ ও শিল্প কারখানা স্থাপনে। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে না পারা এবং আমদানি সক্ষমতার অভাব, দুই ক্ষেত্রেই প্রধান সমস্যা সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে ধীরগতি।

দেশে জ¦ালানির চাহিদা ও সরবরাহ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সরকারি হিসাব মতে, দেশে বর্তমানে প্রায় ৫ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। তবে সরবরাহ হচ্ছে প্রায় অর্ধেক। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় অর্ধেকের চেয়ে কম গ্যাসের সরবরাহের ফলে দেশের শিল্প কারখানা ধুঁকে ধুঁকে চলছে। বিশেষ করে গ্যাসের সংকটে সর্বত্র উৎপাদন ব্যবস্থায় সংকট তৈরি হয়েছে। এর পাশাপাশি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পূর্ণ সক্ষমতা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। জানা গেছে, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা পাঁচ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে মাত্র দেড় থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলো।

এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় সম্পর্কে সম্পর্কে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রেজানুর রহমান বলেন, দেশে গ্যাসের অনেক সংকট আছে। চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত সরবরাহ করা যাচ্ছে না। শিল্প কারখানার মালিকরা সবাই গ্যাস চায়। নতুন নতুন কারখানা গড়ে তোলার জন্য গ্যাসের আবেদন করছে। তবে গণহারে শিল্প কারখানায় গ্যাস সংযোগ দেওয়া যাচ্ছে না। শিল্পে গ্যাস সংযোগের ক্ষেত্রে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। গ্যাস সংযোগ পেলেই দ্রুত সময়ের মধ্যে উৎপাদনে যেতে পারবে, এমন শিল্প কারখানাগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এ লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। সেই কমিটি কাজ করছে।

চেয়ারম্যান বলেন, গ্যাস সংকটের দ্রুত সমাধানের উপায় নেই। সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গ্যাস উৎপাদন বা গ্যাসের জোগান বাড়াতে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়ে কাজ করছে। এ ছাড়া বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি বাড়াতে ল্যান্ডবেজড এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তবে বিষয়টি বাস্তবায়ন করতে হয়তো ৫ বছর সময় লাগবে।

গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে পেট্রোবাংলার পরিকল্পনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সংস্থাটি ১০০ কূপ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ৬৯টি অনুসন্ধান ও কূপ খনন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তবে এই পরিকল্পনা বিগত সরকারের সময়ে গ্রহণ করা হয়েছিল। বাস্তবতা হলো, কূপ খনন প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীরগতির। ২০১৫ সালে যেখানে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন ছিল ২ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট, সেখানে ১০ বছর পরে এসে দেখা যাচ্ছে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করার পরও দেশে গ্যাসের সরবরাহ নেমে এসেছে ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুটে। অর্থাৎ গত দশ বছরে দেশে গ্যাসের সরবরাহে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। পেট্রোবাংলা ও জ¦ালানি বিভাগ মূলত একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্যাসের জোগান ঠিক রাখার চেষ্টা করে চলছে।

দেশে গ্যাসের জোগান কমে যাওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, আমরা জ¦ালানির জোগানে সত্যি এক খারাপ অবস্থার মধ্যে আছি। প্রতি বছর দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন কমছে। যে কোনো সময় বড় সংকটে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের অনুসন্ধান কার্যক্রম পিছিয়ে আছে। ফলে গ্যাসের সংকট তৈরি হয়েছে। প্রতিদিন যেভাবে উৎপাদন কমছে, তাতে যে কোনো সময় বড় গ্যাস সংকট দেখা দিতে পারে। কূপ খনন আরও বাড়ানো উচিত, না হলে আমদানি করে গ্যাস সংকট মোকাবিলা করা কঠিন। গভীর সমুদ্রে মনোযোগ দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, জ¦ালানির সংকট প্রকট হওয়া মানে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়া।

সরবরাহ বাড়াতে সরকারের পদক্ষেপ : অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর শুরুতেই দেশি ও বিদেশি কোম্পানিগুলোর জ¦ালানি খাতের পাওনা পরিশোধ করে দেয়। এরপর নিয়মিত আমদানির সঙ্গে কিছু এলএনজি আমদানি বাড়ায়। তবে চাহিদার তুলনায় সেটা খুই সামান্য। দ্বিতীয়ত ভোলার উদ্বৃত্ত গ্যাস এলএনজি আকারে আনার কথা ভাবে। ২০২৬ সালের শুরু থেকে যাতে আনা যায়, সে জন্য রোডম্যাপও চূড়ান্ত করা হয়। এজন্য কয়েক দফায় ফিল্ড ভিজিটসহ অগ্রাধিকার দিয়ে নানান কর্মকা- পরিচালনা করা হয়। সে সময় বেশকিছু দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান আগ্রহ দেখালেও অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর শেষ হয়ে গেলেও কার্যত কোনো অগ্রগতি নেই।

পরে আবার ভোলা থেকে স্থলভাগে পাইপলাইন নির্মাণের মাধ্যমে গ্যাস আমদানির কথা বলা হয়। তবে সর্বশেষ পেট্রোবাংলা বলছে, পাইপলাইন হবে কিনা সেটার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে প্রক্রিয়াধীন থাকা পাঁচটি কূপের গ্যাস প্রাপ্তি বা রিজার্ভের তথ্য বিবেচনা করে। অর্থাৎ পাইপলাইনের সিদ্ধান্তটিও চূড়ান্ত নয়। তৃতীয়ত আগের সরকারের ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার ১০০ কূপ খননের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। সেখান থেকেও গ্যাস প্রাপ্তি সময়সাপেক্ষ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনের এক নেতা আমাদের সময়কে বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গেও ব্যবসায়ীরা গ্যাসের সংকটের জন্য দফায় দফায় বৈঠক আর আলোচনা করেছেন। কিন্তু সুফল মেলেনি। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যত কথাই বলুক, তারাও মূলত সময়ক্ষেপণ করছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। তিনি বলেন, এখন আমরা পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের দিকে তাকিয়ে আছি। এই ব্যবসায়ী বলেন, দেশে শত শত শিল্প কারখানা গ্যাসের অভাবে রুগ্্ণ হয়ে পড়েছে। কার্যত কোনো সমাধান নেই। ব্যবসায়ীরা হতাশার মধ্যে আছেন।

প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালেও যেখানে অভ্যন্তরীণ উৎসগুলো থেকে ২ হাজার ৭০০ থেকে তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হতো, চলতি আগস্টে তা ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ মিলিয়নে নেমে এসেছে। সব মিলিয়ে সরবরাহ হচ্ছে আড়াই হাজার থেকে ২ হাজার ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে মার্কিন কোম্পানি শেভরনের বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ড থেকেই জোগান এসেছে অর্ধেকের বেশি। তবে এখন সেখানেও উৎপাদন কমে আসছে।

এদিকে গ্যাসের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কমে গেলে সরকার যে বেশি করে এলএনজি আমদানি করবে, সেই সুযোগ নেই। এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি এলএনজি আমদানির অবকাঠামো নেই দেশে। বিদ্যমান দুটি এফএসআরইউ (ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল) দিয়ে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১১শ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমদানি করা সম্ভব। নতুন এফএসআরইউ করতে গেলে দরপত্র চূড়ান্ত করার পর কমপক্ষে ১৮ মাস লাগবে। এক দশক ধরে আলোচিত হচ্ছে ল্যান্ডবেজড টার্মিনালের বিষয়ে। মহেশখালীতে স্থান নির্ধারণ করার পর ২০১৯ সালে প্রাথমিক সমীক্ষা করা হয়। সেখানে বলা হয়, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে কার্যাদেশ দেওয়ার পর ৮০ মাস সময় প্রয়োজন হবে। সেটাও এখনও চূড়ান্ত কিছু হয়নি।

Comment here