কচ্ছপ রেল গতির যুগে - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

কচ্ছপ রেল গতির যুগে

তাওহীদুল ইসলাম : দেশে গড়ে প্রতি সপ্তাহে দুটি করে ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটছে। এতে বাংলাদেশ রেলওয়ে শুধু বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির মুখেই পড়ছে না, ঘটছে শিডিউল বিপর্যয় এমনকি প্রাণহানির মতো মর্মান্তিক ঘটনা। লাইনচ্যুতির এ তথ্য খোদ বাংলাদেশ রেলওয়ের। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, রেল খাতে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের পরও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও যথাযথ তদারকি না থাকার কারণে এমনটা হচ্ছে। পাশাপাশি যাত্রার সময়সূচিও ধরে রাখা যাচ্ছে না রেলপথ-ইঞ্জিন-বগির ত্রুটির কারণে। তারা এসবের জন্য কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতাকেই দায়ী করছেন।

দেশের রেলপথগুলোয় যে গতিতে ট্রেন চলার কথা ছিল, রেলপথ মেরামতের অভাবে চলছে তার চেয়ে অনেক ধীরগতিতে। জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ রুটে আগে ট্রেনের গতি ছিল ঘণ্টায়

৬৮ কিলোমিটার। এখন তা কমিয়ে আনা হয়েছে ৫০ কিলোমিটারে। এ ছাড়া জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী এবং আখাউড়া-সিলেট রুটেও নির্ধারিত গতির চেয়ে ধীরে ট্রেন চালনার নির্দেশনা রয়েছে। এমন আরও অনেক রুটে ট্রেনের গতি কমানোর নির্দেশনা রয়েছে। এর মূল কারণ রক্ষণাবেক্ষণের অভাব। সঠিক খাতে বরাদ্দ, প্রয়োজনীয় মেরামতকাজ ও যথাযথ তদারকির অভাবে গতির যুগে এসেও এভাবেই গতি হারাচ্ছে রেল।

নতুন নতুন বগি রেলের বহরে যোগ হলেও যাত্রীসেবার বিস্তার ঘটছে না। কারণ পুরনো বগি মেরামতের জন্য ওয়ার্কশপে পাঠানো হলেও তা মেরামত করা হয় না। সঙ্গত কারণেই সেসব বগি আর বহরে ফিরে আসে না। তাই একদিকে নতুন বগি এলেও অচল পুরনো বগি মেরামত করে সচল না করায় বাড়ছে না বগির সংখ্যা।

দেশের বিভিন্ন রুটে বর্তমানে ৩৫৬টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করে। এর মধ্যে ৯৬টি আন্তঃনগর। মৈত্রী ও বন্ধন এক্সপ্রেস নামে দুটি ট্রেন আন্তঃদেশীয়। এ ছাড়া রয়েছে লোকাল, মেইল, কমিউটার ট্রেন। এরও বাইরে মালবাহী ট্রেন রয়েছে ২৬টি। রেলসংশ্লিষ্টরা জানান, ট্রেনের লাইনচ্যুতির মূল দুটি কারণ লাইনে ত্রুটি নয়তো বগিতে ত্রুটি।

জরাজীর্ণ লাইনে বেশি গতিতে ট্রেন চললে, রেলের যে ধাতব পথ সে পথের নিচে পর্যাপ্ত পাথর না থাকলে, সিøপার বা নাটবল্টু আলগা হয়ে গেলে ট্রেন লাইনচ্যুত হতে পারে। এ কাজে নিয়োজিত ওয়েম্যান, পোর্টাররা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন না। জানা গেছে, মাঠপর্যায়ে প্রয়োজনীয় এসব কর্মচারী নিয়োগ করা হলেও তাদের দাপ্তরিক কর্মকা-ে নিযুক্ত রাখা হয়। লাইনচ্যুতির আরেকটি কারণ হচ্ছে বগির নিচের অংশের যন্ত্রাংশ যাকে আন্ডারগিয়ার বলা হয়, সেটিতে ত্রুটি থাকা। এটি নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না বলে অভিযোগ আছে। অনেক সময় অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে কলকব্জা বিকল হয়ে যায়। আর কলকব্জা বিকল হলেও ঘটতে পারে লাইনচ্যুতি।

চাহিদার তুলনায় আসনসংখ্যা কম থাকায় টিকিট পেতে কষ্ট করতে হয় যাত্রীদের। এর পর স্টেশনে গিয়ে যখন দেখা যায় যথাসময়ে ট্রেন আসেনি, তখন ফের ভোগান্তি পোহাতে হয়। কাক্সিক্ষত বাহনের গন্তব্য জানতে এসএমএস করার সুযোগ থাকলেও অনেক সময় খুদেবার্তা পাঠিয়ে সঠিক জবাব মেলে না। এরও পর যাত্রাপথে লাইনচ্যুতির শঙ্কা থেকে যায়। সেবার এমন মানের কারণ রেল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা বলেই মনে করা হচ্ছে।

বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, কারিগরি ত্রুটি বা সংকেতের ভুল হলে রেল দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু লাইনচ্যুতিটাকে দুর্ঘটনা হিসেবে মেনে নেওয়া যায় না। অবহেলার কারণে এমনটি হতে পারে। রেলপথ ও ইঞ্জিন-কোচের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এমনটি হচ্ছে।

এ নিয়ে রেলকর্মকর্তারা বলেন, প্রতিটি আন্তঃনগর ট্রেন এক সপ্তাহ পর একদিন বন্ধ থাকে। পথে একটি ট্রেনের লাইনচ্যুতি হলে এক সপ্তাহ লাগে তা স্বাভাবিক হতে। গত ১১ বছরে রেল খাতে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। নতুন লোকবল নিয়োগ হয়েছে ১৩ হাজারের মতো। এর পরও রেলে লাইনচ্যুতির ঘটনা কমেনি। সাধারণত পাথর, সিøপার চুরিকে ট্রেনের লাইনচ্যুতির জন্য দায়ী করা হয়। এটি অবশ্যই কারণ। তবে এগুলো দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্তরা যথাযথ কাজ করছেন কিনা তা দেখার কেউ নেই। এদের মনিটরিংয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীরা মাঠপর্যায়ে পরিদর্শন না করে টেবিলে বসে ফাইল সই করেন কিনা তা খতিয়ে দেখা জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোফাজ্জেল হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, ট্রেনের শিডিউল ধরে রাখা বড় কাজ। সময়মতো মানুষকে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারাটাই দায়িত্ব। এর ব্যত্যয় ঘটলে এর কারণ বের করতে হবে। রেলওয়ের সংশ্লিষ্টদের এদিকে দৃষ্টিপাত করতে ইতোমধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সূত্রমতে, রেলপথের যে রুটিন মেরামত, সেটি হয় অনুন্নয়ন তথা রাজস্ব খাত থেকে। রেলওয়ের মহাপরিচালকের মাধ্যমে প্রধান প্রকৌশলী, প্রধান যন্ত্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা এসব অর্থ খরচ করে থাকেন। রাজস্ব খাতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বরাদ্দ রয়েছে ৩ হাজার ৪৬১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এর আগের অর্থবছরে (২০১৭-১৮) বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৯১৮ কোটি ২ লাখ ৭২ হাজার টাকা। এর ৩৪.০৪ শতাংশ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে বরাদ্দ ছিল। অর্থাৎ এ খাতে ছিল ৯৯৩ কোটি ১৭ লাখ ৩২ হাজার টাকা। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৮৩৫ কোটি ৫২ লাখ ৫০ হাজার টাকা; মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে ৮৫৫ কোটি ২৮ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। প্রতিবছরই বড় একটি অংশ বরাদ্দ থাকে রুটিন মেরামত কাজে। কিন্তু এতে সঠিক খাতে অর্থ খরচ হচ্ছে নাÑ এমন কথাও উঠেছে।

রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণের ব্যপারে অপারেশনাল রিভিউ মিটিংয়ে বলা হয়েছে, ট্রেম্পিং মেশিন এবং ট্র্যাক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা অন্য খাতে ব্যয় করা যাবে না। উভয় অঞ্চলে ট্রেম্পিং মেশিনের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া কংক্রিট সিøপারে যান্ত্রিক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ইউনিট তৈরির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রেলপথ পরিদর্শনকালে পাওয়া অসঙ্গতি দ্রুত নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দিয়েছেন রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. শামসুজ্জামান। তিনি বলেন, রেলের সেবার মান বাড়াতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

এদিকে দেশের অধিকাংশ রেলপথই সিঙ্গেল লাইনের। ফলে একই রুটে একই সময়ে একাধিক ট্রেন আসা যাওয়া করতে পারে না। একটি রুটে একটি ট্রেন আসা বা যাওয়ার পর অন্য একটি ট্রেন আসা-যাওয়া করে। এ জন্য অনেক সময় দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয়। আর শিডিউল বিপর্যয় হলে তো কথাই নেই। দেশের উত্তরাঞ্চলের রেলপথে একটি ক্রসিং থেকে আরেকটি ক্রসিংয়ের দুরত্ব বেশি হওয়ায় ট্রেনগুলোকে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হয় বলে এ রুটে শিডিউল বিপর্যয় ঘটে সর্বাধিক। অথচ ডাবল লাইন হলে এ সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়ে যেত। এ নিয়ে বোধ করি কোনো ভাবনাই নেই দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদেরÑ অনেকে এমনটিই মনে করেন।

Comment here