টিকে থাকার বাজেট - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
ঢাকাসমগ্র বাংলা

টিকে থাকার বাজেট

আবু আলী : গবেষণায় দেখা গেছে, কোভিড ১৯-এর প্রভাবে দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। কাজ হারিয়েছেন ৬২ শতাংশ নিম্নআয়ের মানুষ। স্থবির হয়ে পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য, উৎপাদন ও বিপণন। ফলে রাজস্ব আহরণে নেমেছে ধস। আমদানি-রপ্তানিতে নেই সুখবর। স্বাস্থ্য খাত বেহাল। এমন পরিস্থিতির মধ্যে আজ বৃহস্পতিবার আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

জানা গেছে, এবারের বাজেট গতানুগতিক ধারার হবে না। দেশের মানুষের জীবনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। অর্থনীতি যাতে আগের ধারায় ফিরতে পারে বাজেটে সে দিকে লক্ষ্য রাখা হয়েছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটের সেøাগান ঠিক করা হয়েছেÑ ‘অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ পথ পরিক্রমা’। বাজেট বক্তৃতায় থাকছে সরকারের অতীতের অর্জন এবং উদ্ভূত বর্তমান পরিস্থিতির সমন্বয়। বাস্তবতার কারণে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে। পাশাপাশি কৃষি খাত, খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা এবং কর্মসংস্থানকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে নানা ধরনের কৃষি ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা সম্প্রসারণ, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য পুনরুদ্ধার করাসহ কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বাজেটে বিভিন্ন প্রস্তাবনা থাকছে। দেশের সাধারণ মানুষের জীবন টিকিয়ে রাখতে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের বিষয়ও তুলে ধরবেন অর্থমন্ত্রী।

জানা গেছে, বিনিয়োগ ধরতে দেওয়া হচ্ছে নানা ধরনের ছাড়। কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ বাড়ানো হচ্ছে। আবাসন খাতে কালো টাকা বিনিয়োগের সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি করপোরেট কর হার কমানো হচ্ছে। বিনিয়োগ বাড়াতে করপোরেট ট্যাক্স কমানো হচ্ছে। দীর্ঘ ৫ বছর পর করপোরেট ট্যাক্স ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে

৩২ শতাংশ করা হচ্ছে। সর্বশেষ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে করপোরেট ট্যাক্স আড়াই শতাংশ কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করা হয়। তবে অপরিবর্তিত থাকবে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি, ব্যাংক, বীমা, মোবাইল অপারেটর ও সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের করপোরেট ট্যাক্স হার।

এ ছাড়া নতুন করে কয়েকটি শিল্পে কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে আর্টিফিসিয়াল ফাইবার প্রোডাকশন, ন্যানো টেকনোলজি বেজড প্রোডাক্ট, আর্টিফিয়াল ইন্টেলিজেন্স, অটোমোবাইল পার্টস, রোবোটিক ডিজাইন অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং, ইলেকট্রিক্যাল ট্রান্সফরমার প্রোডাকশন, এয়ারক্রাফট মেইনটেন্যান্স অ্যান্ড সার্ভিস শিল্পকে কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।

শেয়ারবাজারেও কালোটাকার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। আয়কর অধ্যাদেশে ১৯এএএএ ধারা যুক্ত করা হচ্ছে। এ ধারা অনুযায়ী আগামী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ১০ শতাংশ কর দিয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) তালিকাভুক্ত স্টক, শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড এবং সরকারি বন্ড ও ডিভেঞ্চারে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।

সাধারণ মানুষের করমুক্ত আয়ের সীমা ৫০ হাজার টাকা বাড়িয়ে ৩ লাখ টাকা করা হচ্ছে। ফলে অনেক মানুষ কর থেকে মুক্তি পাবেন। অন্যদিকে সর্বোচ্চ করহার ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হচ্ছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের সুবিধার্থে বাজেটে টার্নওভার ট্যাক্সের হার কমানো হচ্ছে। এটি ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হচ্ছে। ভ্যাট অব্যাহতির সীমা আগের মতোই ৫০ লাখ টাকা এবং টার্নওভারের ঊর্ধ্বসীমা ৩ কোটি টাকা থাকছে। তবে সব শ্রেণির ব্যবসায় নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে।

বাজেটের পরিসংখ্যান : আগামী অর্থবছরে বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৪৪ হাজার ৮১০ কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরে বাজেটের আকার ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। আর মোট আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮২ হাজার ১৬ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছর থেকে ৩৮ কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরে মোট আয় ধরা হয়েছিল ৩ লাখ ৮১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে ১ লাখ ৮৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থরের চেয়ে ৪৪ হাজার ৭৭২ কোটি টাকা বেশি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, চলতি বছরের চেয়ে ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এনবিআরকে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছিল ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, পৃথিবীজুড়েই বইছে করোনার ঝড়। আগেও সংকট এসেছে। তবে এমন করে একসঙ্গে দুনিয়াজুড়ে আসেনি। বিগত কয়েক দশক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য নিরসনের যে সুফল আমরা পাচ্ছিলাম, মনে হয় এক ধাক্কায় সেসব ধুয়েমুছে যাচ্ছে। করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির আলোকে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার পরামর্শ দেন তিনি। তিনি বলেন, এ বছর স্বাস্থ্য খাতের বাজেট হবে। এটি জনগণের বেঁচে থাকার বাজেট। আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়েও যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে। এবার চলমান সংকটকে মোকাবিলা করে টিকে থাকার বাজেট হবে।

এনবিআর সাবেক চেয়ারম্যান এবং সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, বিভিন্ন খাতে কিছু ব্যয় হয় যা একেবারেই প্রয়োজনীয় নয়। এ ধরনের ব্যয় যথাসম্ভব কমিয়ে স্বাস্থ্য খাত ও সামাজিক নিরাপত্তার ব্যয় বাড়াতে হবে। অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য যেসব খাত বন্ধ থেকেছে, সেখানে প্রণোদনা দিতে হবে, যাতে এগুলো টিকে থাকতে পারে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ বছরের বাজেট অন্য যে কোনো সময়ের বাজেটের চেয়ে ভিন্ন। এবারের বাজেটের নিরূপণ হওয়া উচিত স্বাস্থ্য, মানবিক এবং অর্থনৈতিক সংকটকে সামনে রেখে। এ বিষয়গুলো এ সময়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

Comment here