ঢাকার বাতাস বিষে নীল - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

ঢাকার বাতাস বিষে নীল

নির্মল বাতাসের পরিবর্তে রাজধানীবাসী প্রতিটি নিঃশ্বাসে বিষ গিলছে প্রতিনিয়ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেগাসিটি ঢাকার ২ কোটিরও বেশি বাসিন্দা বিপজ্জনক বায়ুদূষণের মধ্যে বসবাস করছেন। এখন বছরের ১২ মাসই ঢাকার বাতাসে বিষ থাকছে। খালি চোখে দেখা যায় না কিন্তু আমাদের জীবনের শত্রু এমন ৭ থেকে ১০টি ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান মিলেছে ঢাকার বাতাসে। এসব ব্যাকটেরিয়া মানবদেহের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করছে। বিশ^ব্যাংকের তথ্যমতে, ঢাকা বিশ্বের সর্বাধিক দূষিত শহর এবং বাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় দ্বিতীয়। এ তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে ভারতের দিল্লি। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ুদূষণের জেরে প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ১ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। ওয়ার্ল্ড এয়ার কোয়ালিটির প্রতিবেদন অনুয়ায়ী, ২০১৬-২০২৩ সাল পর্যন্ত আট বছরের মধ্যে মাত্র ৪৭ দিন নির্মল বায়ু সেবন করেছে রাজধানীবাসী।

এদিকে বায়ুদূষণ রোধে পর্যাপ্ত আইন ও বিধিমালা থাকলেও কাক্সিক্ষত সফলতা আসছে না। বায়ুদূষণ রোধে সব ধরনের পদক্ষেপই নেওয়া হচ্ছে বলে আমাদের সময়কে জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী। তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকবল সংকট ও সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সমন্বয়হীনতার বিষয়টিও স্বীকার করেছেন তিনি।

গবেষকরা বলছেন, চলমান মেগা প্রকল্প, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, নির্মাণাধীন স্থাপনা, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, ইটভাটা, বসতবাড়ি ও কলকারখানার বর্জ্যসহ নানাবিধ কারণে ঢাকার বাতাস দূষিত হচ্ছে। এসবের ফলে রাজধানীর বাতাসে যুক্ত হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সিসা, নাইট্রোজেন, হাইড্রোকার্বন, বেনজিন, সালফার ও ফটোকেমিক্যাল অক্সিডেন্টস। জ্বালানির দহন, বনভূমি উজাড় প্রভূতি কারণে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। ঢাকার এমন বায়ু স্বাস্থ্যের ওপর নানান নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ফুসফুসের বিভিন্ন রোগ যেমন নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন জটিলতায় পড়ছেন নগরবাসী।

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) তথ্যমতে, নির্মাণকাজ বা রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি থেকে প্রায় ৩০ শতাংশ বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। শিল্পকারখানা বা ইটভাটা থেকে ২৯ শতাংশ, যানবাহন থেকে ১৫ শতাংশ, আন্তঃদেশীয় বায়ুপ্রবাহের কারণে ৯.৫ শতাংশ বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। এ ছাড়া গৃহস্থালি ও রান্নার কাজ থেকে ৮.৫ শতাংশ এবং বর্জ্য পোড়ানোর কারণে প্রায় ৮ শতাংশ বায়ু দূষিত হয়ে থাকে। বায়ুদূষণের জানা উৎসগুলোর মধ্যে দেখা যায় যে, ঢাকার চারপাশে প্রায় ১২৫০টি ইটের ভাটা আছে। এগুলো থেকে প্রতিনিয়তই বায়ুদূষণ হচ্ছে। ঢাকাতে প্রায় ১৫ লাখ যানবাহনের এক-তৃতীয়াংশই ফিটনেসবিহীন। ফিটনেসবিহীন এসব যানবাহনের দুই-তৃতীয়াংশই আবার গণপরিবহন।

বাংলাদেশ শিল্প ও বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাজধানীতে ৪৬-৬৪ শতাংশ পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন (অপরিশোধিত তেল পুড়ে তৈরি হওয়া রাসায়নিক) নির্গত হয় যানবাহনের ধোঁয়া থেকে। বিশেষ করে ফিটনেসবিহীন যানবাহন থেকে এ ধরনের রাসায়নিক বেশি নির্গত হয়। এ ধোঁয়ায় রয়েছে উচ্চমাত্রার ক্ষতিকর কার্সিনোজেনিক বেনজো এ পাইরিন, যা ক্যানসার সৃষ্টিকারী।

গবেষণা প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যিনি শীতে প্রতিনিয়ত মতিঝিল, প্রেসক্লাব যাতায়াত করেন তিনি দৈনিক গড়ে ৯.৭০-১১.২ মাইক্রোগ্রাম বেনজো এ পাইরিনের মতো পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন গ্রহণ করতে বাধ্য হন। শীতকালে এই শোষণের মাত্রা ২.৩-২.৭ গুণ বেড়ে যায়। যার ১.২২ মিউগ্রাম সরাসরি পিএম ২.৫ শোষণের মাধ্যমে ব্যক্তির অ্যালভিওলিতে (ফুসফুসের ছোট থলি বা ক্ষুদ্র রন্ধ্র) জমা হচ্ছে। যা পরে রক্ত সরবরাহের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণ যন্ত্র দিয়ে বায়ুর মান মাপা হয়। মূলত বাতাসে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা পিএম ২.৫-এর পরিমাণ পরিমাপ করে বায়ুর মান নির্ধারণ করা হয়। এয়ার ভিজুয়ালের হিসাবে, বায়ুর মান ০ থেকে ৫০ থাকলে ওই স্থানের বায়ু ভালো। আর মান ২০০ থেকে ৩০০-এর মধ্যে থাকা মানে খুবই অস্বাস্থ্যকর। বায়ুর মান ৩০০-এর বেশি থাকা মানে ওই স্থানের বায়ু ‘বিপজ্জনক’।

সাম্প্রতিককালে ঢাকার বাতাসে ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পেয়েছে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়নকেন্দ্র। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, অন্যান্য দূষণের সঙ্গে ঢাকার বাতাসে ৭ থেকে ১০ রকমের ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে, যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। শহরের রাস্তার ধারের ড্রেনগুলো অধিকাংশ খোলা থাকে। ফলে সেগুলো থেকে বাতাসে ব্যাকটেরিয়া মিশছে।

বিশ্বব্যাংকের গবেষণা তথ্যমতে, বাংলাদেশের দূষণপ্রবণ এলাকাগুলোর প্রায় ১৪ শতাংশ বাসিন্দা বিষণœতায় ভুগছেন, যা কম দূষণ আক্রান্ত এলাকা থেকে অনেক বেশি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, সংস্থাটি কর্তৃক নির্ধারিত মাত্রা থেকে ১ শতাংশ দূষণ বাড়লে বিষন্নতায় ভোগা মানুষের সংখ্যা ২০ গুণ বেড়ে যেতে পারে।

ঢাকার ধুলাদূষণ নিয়ে ক্যাপসের একটি গবেষণা আছে। এতে দেখা গেছে, ঢাকা শহরের গাছপালায় প্রতিদিন ৪৩৬ টন ধূলিকণা জমে। সেই হিসাবে প্রতিমাসে ১৩ হাজার টন ধুলা জমার হিসাব পেয়েছেন গবেষকরা। জমে থাকা এ ধুলা দিনের বেলা বাতাসের সঙ্গে মিশে যেমন দূষণ বাড়ায়, তেমনই রাতে গাড়ির অতিরিক্ত গতির সঙ্গে বাতাসে উড়তে থাকে। ফলে দিনের বেলার চেয়ে রাতের বেলায় বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়ে যায়।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের যে ইটভাটাগুলো, বিল্ডিংয়ে যে নির্মাণ কাজ চলে, নিয়ম হচ্ছে সেটা ঢেকে রাখা যেন ধুলাবালি বাইরে না যায়। এ ছাড়া ঢাকার আশপাশের এলাকা থেকে যে বালি সিমেন্ট পরিবহন করা হয় শহরে, সেটিও বায়ুদূষণের একটি কারণ। আমরা যে জ্বালানি ব্যবহার করি, বিশেষ করে ডিজেল- ডিজেলের ভেতর যে সালফার থাকে, তার পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেশি। এটিও একটি কারণ। আরেকটি কারণ হলো ট্রান্সবাউন্ডারি, যেটি আমাদের সীমানার বাইরে থেকে বায়ুপ্রবাহের সঙ্গে আসছে।

মন্ত্রী বলেন, আমরা এখন যেভাবে এগোচ্ছি, সেটা হলো, আমরা ইটভাটাগুলো চিহ্নিত করেছি। ইটভাটা শুধু কয়েকটা বন্ধ করে দিলে হবে না। আমাদের এখানে যেভাবে সনাতন পদ্ধতিতে ইট বানানো হচ্ছে, সেটি বন্ধ করে বিকল্প পদ্ধতিতে যেতে হবে। এখন যেটা হয়, সেটাতে দুরকম ক্ষতি হচ্ছে- একটি হলো কৃষি মাটির ব্যবহার। আমাদের হিসাবে প্রতিমাসে ১৩ কোটি মেট্রিক টন কৃষি মাটি আমরা ব্যবহার করছি এবং যখন ইট পোড়ানো হচ্ছে তখন ওই ধোঁয়াটা বায়ুর দূষণ ঘটাচ্ছে। আমরা এখন যেতে চাইছি ব্লকে। সেটা চার বছরের পরিকল্পনা। আমরা চাইছি দূষণের মাত্রা যতটা সম্ভব কমিয়ে রাখা এবং পর্যায়ক্রমে উৎসগুলো চিহ্নিত করা।

সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, এসব সমস্যা রাতারাতি তৈরি হয়নি। তাই এর সমাধানও রাতারাতি হবে না। তবে আমরা যদি একটি পরিকম্পনা নিয়ে এগিয়ে যাই, তাহলে একটা পর্যায়ে আমরা বায়ুর মান ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে দেখতে পাব। বেইজিংয়েও আট বছর লেগেছে এ সমস্যা সমাধানে।

নানা সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, তদারকির ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। যেমন পরিবেশ অধিদপ্তর। তাদের দায়িত্ব বিভিন্ন মানমাত্রা নির্ধারণ করা। কোনটা গ্রহণযোগ্য বা গ্রহণযোগ্য নয়, তা নির্ধারণ করা। দূষণ আর সহনীয় মাত্রা নির্ধারণ করা। আমাদের মূল কাজ সেটা। এখন আমরা যদি যানবাহনের কথা বলি, তাহলে যানবাহনের ফিটনেসের দায়িত্ব বিআরটিএর। এ ছাড়া সিটি করপোরেশন এবং মহানগর পুলিশেরও দায়িত্ব আছে। সুতরাং এখানে আমাদের সমন্বয়টাকে আরও কার্যকর করতে হবে। এ ছাড়া আমাদের আইনবিধি-নীতিমালা সবই আছে। এর সঙ্গে আমাদের সমন্বয়টা আরও বেশি কার্যকর করতে হবে। আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সমন্বয় ও লোকবল। স্থানীয় পর্যায়ে আমাদের পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকবলেরও সংকট আছে।

স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়নকেন্দ্রের অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, দিনের পর দিন বায়ুদূষণ বাড়ছে। ঢাকা ছাড়াও সারাদেশে বায়ুদূষণের পরিমাণ বাড়ছে। ঢাকা তো প্রায় বসবাসের অযোগ্য শহরে পরিণত হচ্ছে। বায়ুদূষণে স্বাস্থ্য ও আর্থিক খাতের ক্ষতি বিবেচনায় সরকার নির্মল বায়ু আইন না করে শুধু নীতিমালা করার কথা বলছে। সারাদেশের জন্য আইন করা প্রয়োজন। খ-িত পদক্ষেপ কখনো সুফল বয়ে আনতে পারে না। তিনি বলেন, এতদিন আমরা মনে করতাম, ইটভাটা হচ্ছে ঢাকার বায়ুদূষণের ৬০-৬৫ শতাংশ উৎস। কিন্তু বায়ুদূষণকারী উপাদানগুলো বিশ্লেষণ করে এখন মনে হচ্ছে, রাজধানীতে বিপুল পরিমাণে মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি থেকে বের হওয়া কালো ধোঁয়া, শিল্পকারখানার ধোঁয়া ও সীমান্ত পেরিয়ে আসা দূষিত বায়ু ঢাকা শহরের বাতাসকে বিষিয়ে তুলছে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক এবং গবেষক অধ্যাপক ড. আবদুস সালাম আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের দেশে বায়ুর যে দূষণ সেটি মানব স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তাই আমাদের ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু সুরক্ষানীতি যেমন : মাস্ক পরিধান করা, বেশি দূষিত এলাকাগুলো এড়িয়ে চলার মতো উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি বলেন, সরকার কিছু পদক্ষেপ নিলেও তা যথেষ্ট নয়। এটিকে আরও বেশি কার্যকর করতে হবে। স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া বায়ুদূষণ কমিয়ে আনতে সরকার বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ফোরামে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতে হবে।

Comment here