নজরুল ইসলাম : ঢাকায় আগামী ১০ ডিসেম্বরের মহাসমাবেশে কয়েক লাখ নেতাকর্মীর জমায়েত ঘটাতে চায় বিএনপি। এই মহাসমাবেশের মাধ্যমে সংসদ বিলুপ্তের পাশাপাশি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলে ধরতে চায় দলটি। এ জন্য সরকারকে একটি আলটিমেটাম দেওয়ারও চিন্তা আছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের।
দলের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা আমাদের সময়কে বলেন, বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে সরকারকে চাপে রাখতে নিয়মতান্ত্রিক কিছু কর্মসূচিও হাতে নেওয়া হবে, যাতে দাবি আদায়ে একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত করা যায়। আর কর্মসূচি যা-ই দেওয়া হোক, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে নিজ থেকে কোনো সংঘাতে জড়াবে না বিএনপি। তবে আঘাত এলে ছেড়েও কথা বলবে না।
বিএনপি নেতাদের ভাষ্য, কয়েক মাস আগেও কল্পনা করা যায়নি বিএনপি এভাবে জেগে উঠবে। গত শনিবার রংপুরের বিভাগীয় সমাবেশে পরিবহন ধর্মঘটের মধ্যে বড় জমায়েত ঘটানোর পর নেতাদের মনোভাবে পরিবর্তন এসেছে।
রংপুর সমাবেশের একদিন পর গতকাল নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে রক্ষায় আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। সবার প্রতি আহ্বান, আসুন আরও শক্তি সঞ্চয় করে এই সরকারকে পরাজিত করি।’
চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা ও রংপুরের পর আগামী ৫ নভেম্বর বরিশালে বিভাগীয় গণসমাবেশ করবে বিএনপি। এরপর ১২ নভেম্বর ফরিদপুর, ১৯ নভেম্বর সিলেট, ২৬ নভেম্বর কুমিল্লা, ৩ ডিসেম্বর রাজশাহী গণসমাবেশ করবে।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, ঢাকার মহাসমাবেশ হয়তো তারা সফল করতে পারবেন। কিন্তু চূড়ান্ত আন্দোলন নিয়ে বেশ চিন্তিত। তৃণমূলের নেতারাও ঢাকায় শক্তি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন।
দলের নেতারা বলছেন, ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোয় সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এসব জেলার সাংগঠনিক শক্তি পরখ করার পাশাপাশি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা বিচার-বিশ্লেষণ করে চূড়ান্ত আন্দোলনের দিনক্ষণ ঠিক করা হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমরা ভোটাধিকার, আইনের শাসন ও জ্বালানিসহ নিত্যপণ্যের দাম কমানোর দাবিতে আন্দোলন করছি। দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোও একই দাবি নিয়ে রাজপথে সোচ্চার।’
গয়েশ্বর বলেন, ‘বিএনপিকে ক্ষমতায় নিতে হবে- এ কথা আমরা কিন্তু বলিনি। আমরা তো সাধারণ মানুষের মনের কথা বলছি। এ কারণেই সব বাধা পেরিয়ে শুকনা খাবার নিয়ে হেঁটে সাধারণ মানুষ বিভাগীয় সমাবেশে অংশগ্রহণ করছেন। যেটা আমরা ’৭১ সালে দেখেছি। ফলে আওয়ামী লীগের মধ্যে এখন ক্ষমতা হারানোর ভীতি তৈরি হয়েছে। ভীতি থেকে প্রথমে আওয়ামী লীগ পরিবহন মালিকদের চাপ দিয়ে বিভাগীয় সমাবেশগুলোয় ধর্মঘটসহ নানা বাধা দেওয়া শুরু করে। তাতেও কাজ না হওয়ায় এবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে নিজেরাই মাঠে নেমেছে। কিন্তু জনগণ তাদের সঙ্গে নেই।’
দশম জাতীয় জাতীয় সংসদ থেকে বিরোধী দলের আসনেও নেই বিএনপি। দলের নেতারা জানান, ২০১৪ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে বেশ চাপে পড়ে যায় বিএনপি। এর মধ্যে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ নির্বাচনের আগে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাজা হয়। তাকে ছাড়াই নানা সমালোচনার মধ্যে ওই নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। আন্দোলনের অংশ হিসেবে ওই নির্বাচনে অংশ নিলেও সফলতা আসেনি।
দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর কিছু জ্যেষ্ঠ নেতার পরামর্শে তৃণমূল পুনর্গঠনে জোর দেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। পাশাপাশি স্কাইপির মাধ্যমে বিভিন্ন জেলা বিএনপির নেতাদের মতামত নেন। ভার্চুয়াল উপায়ে ধারাবাহিকভাবে সাত দিন নির্বাহী কমিটির নেতাদের মতামত নেন। সর্বশেষ বিভাগীয় সমাবেশ শুরুর আগে ৮২ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি/আহ্বায়ক এবং সাধারণ সম্পাদক/সদস্য সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল আমাদের সময়কে বলেন, দলকে ঘুরে দাঁড়াতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। ভেতরে ভেতরে তিনি দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করেছেন, তাও দৃশমান হয় গত জুলাই মাসে। বিশেষ করে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে কর্মসূচি শুরু হলে তা আরও স্পষ্ট হয়।
দলীয় সূত্র জানায়, জামায়াত নিয়ে অস্বস্তিতে থাকা বিএনপি একাদশ জাতীয় জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে ২০ দলীয় জোটকে নিষ্ক্রিয় রেখে একলা চল নীতি অনুসরণ করে আসছে। এই অবস্থায় চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে দলটি যুগপৎ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয়। তার আগে জামায়াতের সঙ্গে বোঝাপড়াও করে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। এখন জামায়াতও যুগপৎ আন্দোলনের কথা বলছে।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ এক নেতা বলেন, প্রায় দুই যুগের জোটসঙ্গী জামায়াতের নেতিবাচক কর্মকা- তুলে ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার দেশে-বিদেশে সুবিধা নিয়ে আসছে। কৌশলে বিএনপি ও জামায়াতকে অভিন্ন চরিত্র হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, মানুষ তার ভোট দিতে পারে না, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষ কষ্টে আছে, বিদ্যুৎসহ নানা সংকটে রয়েছেন তারা। এখন সাধারণ মানুষও বিএনপির সমাবেশগুলোয় যাচ্ছেন। বিদেশিরাও দেশে একটি ভালো নির্বাচন দেখতে চান। এ অবস্থায় আমি মনে করি, বিএনপির একলা চল নীতি তাদের সফলতা এনে দিতে পারে। এক সময় জামায়াতের কারণে অনেক রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে যেতে চাইত না। সেই সংকটও হয়তো কেটে যাবে। ফলে দেশে একটা যুগপৎ আন্দোলনের পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। যেমনটা হয়েছিল ’৯০-এর আন্দোলনে।
Comment here