দিন যায়, সেবার মান বাড়ে না - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

দিন যায়, সেবার মান বাড়ে না

তাওহীদুল ইসলাম : গণপরিবহনের মধ্যে রেল সারাবিশ্বে জনপ্রিয়। এ অঞ্চলে ১৮৬২ সালে রেল চালু হয়। কিন্তু আজও প্রত্যাশিত পর্যায়ে পৌঁছেনি সেবার মান। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ খাতে বৃদ্ধি পেয়েছে বরাদ্দ। কিন্তু একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীর দায়িত্বহীনতায় নিশ্চিত করা যায়নি সেবা। টিকিট সংগ্রহ থেকে শুরু করে প্রতিটি পদে ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা।

চাহিদার তুলনায় আসন কম, তাই টিকিট সংকট থাকে। কিন্তু কালোবাজারে চড়া দরে ঠিকই টিকিট মেলে। ঢাকার কমলাপুর ও বিমানবন্দর স্টেশনে টিকিট কেনায় কিছুটা শৃঙ্খলা রয়েছে। কিন্তু ঢাকার বাইরে অনেক স্টেশনে কালোবাজার ছাড়া টিকিট পাওয়া কঠিন। এ তো গেল টিকিট কেনা। এখানেই দুর্ভোগের শেষ নয়, বরং শুরু। ট্রেনে চড়ার পর দেখা যায় হয়তো আসন ছেঁড়া, নয়তো তেলাপোকা-ছারপোকার যন্ত্রণা। অপরিচ্ছন্নতাও নৈমিত্তিক। এসব অভিযোগ যাত্রীদের কাছ থেকে শুনতে শুনতে কর্মকর্তারা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন যে, এখন আর গা করেন না। এসি আসন, টয়লেট সর্বত্র একই চিত্র।

সারাদেশে চলাচলরত ট্রেনের কী দশা তার একটা দৃষ্টান্ত মেলে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের সোনার বাংলা এক্সপ্রেসের বিবরণ জানলে। সম্প্রতি রেলওয়ের অভ্যন্তরীণ পরিদর্শনেই ভয়াবহ চিত্র ওঠে এসেছে। সেখানে দেখা গেছে- খাবার গাড়ির রান্নাঘরে ইলেকট্রিক সকেট নেই, ফ্রিজ নষ্ট। যাত্রীদের সিটের পেছনে পানি রাখার কেসিং একটাও ভালো নেই। টয়লেটের ফ্যান নষ্ট। নেই টিভি মনিটর। এটি হলো ১৪০৩ নম্বর কোচের চিত্র। ১০০৫ নম্বর কোচের অবস্থা হচ্ছেÑ দরজার লক বিকল, চারটি দরজার মধ্যে পকেট জানালার লক নষ্ট, মূল দরজাও অকেজো। চেয়ারের পেছনের নেট ও পানি রাখার কেসিং নেই। ১৩০৮ নম্বর কোচে ৫টি জানালার পর্দা নেই, সিটের পেছনে টি-টেবিল নেই, টয়লেটের ভেতরে লাইটের কাভার নেই, করিডরের সিলিং লাইটের সুইচ নেই। ১৩১৯, ১১০৭, ১৩২৪, ১৩০৯, ১২০৩, ১২১২, ৬৫১৬, ১০২০, ১৫০৪ এবং ১৪০৪ সব কটি কোচেরই অবস্থা কাছাকাছি। দরজা-জানালা নষ্ট, সুইচ নেই।

এদিকে রেলওয়ের সেবার মান নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। কিছু সমস্যা তুলে ধরে কয়েকটি সুপারিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠিয়েছে ওই সংস্থাটি। সেখানে বলা হয়েছে- একমাত্র ভুক্তভোগীরাই বলতে পারবে রেলওয়ের বর্তমান বেহাল দশা। শিডিউল মেনে ট্রেন না চলা, যাত্রীসেবার মানোন্নয়নে যথাযথ দৃষ্টি না দেওয়া, কোচ অর্থাৎ বগিগুলোর দুরবস্থা, সিংহভাগ ইঞ্জিনের আয়ু ক্ষয়ে যাওয়া, সংশ্লিষ্ট একটি দুষ্টচক্রের দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারিতা ইত্যাদি কারণে রেলের অবস্থা ক্রমশ সূচনীয় হয়ে পড়ছে। যাত্রী চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে কোচগুলো মেরামত করে ব্যবহার করা হলেও এগুলো নিরাপদ নয়। বছরের পর বছর অবহেলা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এ দুরবস্থা বিরাজ করছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑ ট্রেনের বগির অতি পরিচিত দৃশ্য হচ্ছে জানালা নেই, দরজা ভাঙা, বিকল ফ্যান, বাথরুমের করুণ অবস্থা। অতিরিক্ত হকারের চাপ, খাবার গাড়ি নিয়ে সিন্ডিকেট ব্যবসা, টিকিট কালোবাজারির মধ্যেই চলছে রেল। কমলাপুর স্টেশন থেকে দূর-দূরান্তে রওনা হওয়া ট্রেন প্রায়শ পথে বিকল হয়ে পড়ে। বিপাকে পড়েন যাত্রীরা। ইঞ্জিন পরিবর্তন করে এক থেকে দু ঘণ্টা দেরি করে ট্রেন ছাড়ে। এমন অবস্থা ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-দিনাজপুরসহ অধিকাংশ রুটে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, রেলের অন্যতম সমস্যা টিকিট কালোবাজারি। কমলাপুর, বিমানবন্দর স্টেশন ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কৌশলে টিকিট কালোবাজারি করেন। অনলাইনে টিকিট আপলোড করার ৩০ মিনিট পরে সাধারণ যাত্রীরা টিকিট পান না। বলা হয়, সব টিকিট শেষ। অথচ কালোবাজারে চড়া দামে টিকিট মেলে। এ ছাড়া লোকাল ও মেইল ট্রেনে হকারের উৎপাত বেশি। ভৈরব, কিশোরগঞ্জ ও বি-বাড়িয়া এলাকায় এদের আধিক্য চোখে পড়ে। এদের একটা অংশ চুরি, ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত। ট্রেনের মধ্যে ওয়াশরুম বা টয়লেটের সমস্যা প্রকট। মহিলা ও শিশুরা এ কারণে বেশ বিপাকে পড়েন। ট্রেনের বড় সমস্যা হচ্ছে- টিকিট চেকারদের হয়রানি। জরিমানা আদায়ের রসিদ বই হাতে থাকলেও এরা আদায়কৃত টাকা পকেটে রাখেন।

সর্বশেষ রেলওয়ের অপারেশনাল রিভিউ মিটিংয়ের বরাত দিয়ে কর্মকর্তারা জানান, ট্রেনে যাত্রাবিলম্ব হচ্ছে এটা ঠিক। ক্যাপ বোল্ড নষ্ট হওয়ার কারণে ইঞ্জিন ফেইলিউর বেশি হচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকা-সিলেট এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে ট্র্যাকের কারণে এ সমস্যা হচ্ছে। এ ছাড়া সিগন্যাল ফেইলিউর প্রতিরোধে কিছু নির্দেশনা এসেছে। কোন রুটে বেশি ফেইলিউর হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া সিগন্যাল ফেইলিউরের পূর্বাভাস সম্পর্কে জানা সম্ভব কিনা এবং ফেইলিউরের হার সর্বনি¤œ পর্যায়ে রাখার ব্যপারে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা তুলে ধরে প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশনা এসেছে।

এদিকে ট্রেনে খাবার সরবরাহ নিয়েও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ বাড়ছে। সম্প্রতি দুর্র্নীতি দমন কমিশন-দুদক থেকে রেলওয়ের ওপর তৈরি করা প্রতিবেদনে ক্যাটারিং সেবা ও খাবারের মান নি¤œমানের বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অনিয়মের অভিযোগ আছে ক্যাটারিং সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি, চুক্তির নবায়ন নিয়ে। রেলের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান ক্যাটারিং সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। দরপত্র আহ্বান করলেও শর্তের মারপ্যাঁচে নতুন প্রতিষ্ঠান যুক্ত হওয়ার সুযোগ কম। বাসি খাবার চড়া দামে বিক্রির মতো অভিযোগও আছে ট্রেনে। বর্তমানে ট্রেনে ক্যাটারিং সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে বিল্লাল হোসেন অ্যান্ড ব্রাদার্স, হাবিব বাণিজ্য বিতান, সুরুচি ফাস্টফুড এবং শরীফ হোটেল। ট্রেনের খাবার সরবরাহে সুজাউদ দৌলা, মামুন হোসেন, শহিদুল হক বিশ্বাস, আবদুর রাজ্জাক এবং আমিনুল ইসলাম বাবু ব্যবসা করে যাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে। রেলের নিয়মিত তদারকির অভাবে ক্যাটারিং সার্ভিস অত্যন্ত নি¤œমানের পর্যায়ে এসেছে। এ ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ পুরনো। রেল মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ তদন্তেও অনিয়মের চিত্র ওঠে আসে।

দেখা গেছে, ২০১১ সালে পারাবত ট্রেনের খাবার সরবরাহ করা প্রতিষ্ঠানের মেয়াদ শেষ হয় ২০১৫ সালের ৩১ নভেম্বর। এরপর থেকে মেয়াদ বাড়িয়ে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এ রকম সুবর্ণ এক্সপ্রেস, উপকূল, পাহাড়িকা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, অগ্নিবীণা, জয়ন্তিকা, উপবনসহ বেশ কটি ট্রেনের খাবার সরবরাহের জন্য ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি চুক্তিবদ্ধ হয় ক্যাটারিং অপারেটর। ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর মেয়াদ শেষে তা নবায়ন করা হয়। সে কারণে ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সেবা দিতে পারবে। রেলের পূর্বাঞ্চলের মতো পশ্চিমাঞ্চলেও একই দশা। ২০১১ সালের ১ অক্টোবর থেকে ২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মেয়াদে কাজ পায় প্রতিষ্ঠানগুলো। নতুন চুক্তি শেষে এগুলোর মেয়াদ পার হবে ২০২৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। অবশ্য রেলওয়ে সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এসব চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে নিজেরাই ক্যাটারিং সার্ভিস দেবে। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে আপাতত দুটি ট্রেনে এ সেবা দিচ্ছে।

Comment here