নিজস্ব প্রতিবেদক : ‘শুক্কুর বার আসতে আর কত দেরি পাঞ্জেরী?’ ফেসবুকে গত বুধবার রাত ১০টা ১৩ মিনিটে এ পোস্ট করেছিলেন বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের হিসাবরক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌস জান্নাত (৩৫)। কারণ শুক্রবার স্বামী শহিদুল কিরমানি রনি (৪০) ও ৪ বছরের একমাত্র ছেলে এবিএম রুশদিকে নিয়ে ঢাকার বাইরে বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল। আর সে আনন্দ-উৎসবের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে যেন তর সইছিল না তার। কিন্তু তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি একদিন আগেই কি শোক নিয়ে আসছে শুক্রবারটি।
গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে হঠাৎ এক অগ্নিঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সব। আনন্দ পরিণত হয় শোকের অথৈ প্রপাতে। ছেলেকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া হয়নি জান্নাতের। পোড়া শরীরে দগদগে ঘা নিয়ে তিনি ও তার স্বামী এখন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে লাইফসাপোর্টে আছেন; গুনছেন মৃত্যুর প্রহর। আর বাবার হাত থেকে ছিটকে গিয়ে নারীছেঁড়া ধন রুশদি সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেছে চিরছুটিতে; সব কিছুর ঊর্ধ্বে। পুড়ে অঙ্গার ছোট্ট শিশুটির চেহারাটাও চেনা যাচ্ছে না।
গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে ৪টার দিকে নিউ ইস্কাটন মগবাজার দিলু রোডের একটি পাঁচতলা ভবনের (৪৫/এ) গ্যারেজ থেকে সৃষ্ট এ অগ্নিদুর্ঘটনায় শুধু রুশদিই নয়, প্রাণ হারিয়েছেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী আফরিন জান্নাত যূথী (১৭) এবং ভবনটির নিচতলায় অবস্থিত ‘ক্লাসিক ফ্যাশন’ নামে একটি বায়িং হাউসের অফিস সহকারী আব্দুল কাদের লিটন (৪০)।
আগুন থেকে বাঁচতে পাঁচতলা থেকে নিচে নামতে গিয়ে তৃতীয় তলার সিঁড়িঘরেই পুড়ে কয়লা হয়ে যান যূথী। আগুনের লেলিহান শিখার ছোবল থেকে রক্ষা পেতে নিচতলার বাথরুমে ঢুকে পড়েছিলেন আব্দুল কাদের। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। তাদের ৯টি ইউনিট এক সময় ৫টা ৬ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।
আগুনের সর্বগ্রাসী ছোবল থেকে রক্ষা পেতে পাশের ভবনে লাফিয়ে পড়া ছাড়াও দগ্ধ হয়ে ও ধোঁয়ায় শ্বাসনালি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অসুস্থতার কারণে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ওই ভবনের আরও পাঁচ বাসিন্দা। তাদের মধ্যে আগুনে সৃষ্ট ধোঁয়ায় অসুস্থ চারজন সুমাইয়া আক্তার (৩০), মাহাদি (৯), মাহমুদুল হাসান (৯ মাস) ও মনির হোসেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। নিহত যূথীর মা লাল বানু (৩৫) পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি। তারা ওই ভবনের পঞ্চম তলার বাসিন্দা এবং একই পরিবারের সদস্য।
শেখ হাসিনা ন্যাশনাল বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, দগ্ধ দম্পতির অবস্থা আশঙ্কাজনক। এদের মধ্যে জান্নাতের শরীরের ৯৫ শতাংশ ও রনির শরীরের ৪৩ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। পুড়ে গেছে শ্বাসনালিও। তাদের ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। অন্যরা আশঙ্কামুক্ত।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ওই ভবনের কেয়ারটেকার লুৎফর রহমান জানান, ভোরে তারা সবাই ঘুমিয়ে ছিলেন। হঠাৎ নিচতলায় গাড়ির গ্যারেজ থেকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। একে একে পুড়ে যায় পার্কিংয়ে থাকা পাঁচটি প্রাইভেটকার ও দুটি মোটরসাইকেল। সেই আগুন ছড়িয়ে হু হু করে উঠতে থাকে ওপরের দিকে। আগুন লাগার পর লুৎফর রহমান বাইরে বের হয়ে সবাইকে চিৎকার করে বের হতে বলেন। এ সময় চিৎকার করে দিগি¦দিক ছুটতে থাকেন বসবাসকারীরা। নিচে আগুনের লেলিহান শিখার কারণে প্রায় সবাই পাশের ভবনে লাফিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচাতে পারলেও পুড়ে ও ধোঁয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় এক শিশু ও এক তরুণীসহ ৩ জন। ধোঁয়ায় অসুস্থ হওয়া ছাড়াও আহত ও অগ্নিদগ্ধ হয় অন্তত ১০ জন। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা হতাহতদের উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে যায়।
ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের ডিউটি অফিসার রাসেল শিকদার জানান, আগুন নিয়ন্ত্রণের পর ভবনটির নিচতলার বাথরুম থেকে একজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আর ভবনটির তৃতীয় তলার সিঁড়ি থেকে এক তরুণী ও এক শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। দগ্ধ, আহত ও ধোঁয়ায় অসুস্থদের চিকিৎসার জন্য ঢামেক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে- নিচতলার পার্কিং এলাকায় বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত। পরে ওই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভবনে। পূর্ণ তদন্তের পর আগুনের কারণ ও ক্ষতির পরিমাণ জানানো যাবে।
ময়নাতদন্তের জন্য লাশ গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) মর্গে পাঠায় পুলিশ। এ সময় নিহতদের স্বজনের আহাজারিতে এক হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয় মর্গ চত্বরে। আহাজারি করে শিশু রুশদির দাদা একেএম শহীদুল্লাহ বলেন, এটিই তো আমার নাতির লাশ। আল্লাহ তুমি আমাদের এ কেমন পরীক্ষায় ফেললা। একমাত্র নাতিকে ছেড়ে একবার তিনি দৌড়ে যান বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন ছেলে ও বউমার কাছে। চোখের জল মুছতে মুছতে আবার ফিরে আসেন তিনি প্রিয় নাতির লাশের কাছে।
অশ্রুসিক্ত একেএম শহীদুল্লাহ জানান, বিআইভিপি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার ছিলেন তার একমাত্র ছেলে শহিদুল রনি। পাশাপাশি আইসিএমএ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রভাষক হিসেবেও কাজ করতেন। তার স্ত্রী জান্নাত বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের হিসাবরক্ষক ছিলেন। দিলু রোডের ওই বাসার তৃতীয় তলায় সপরিবারে থাকতেন তিনি। তাদের গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলায়।
আগুন লাগার পর রুশদিকে কোলে নিয়ে দৌড়ে ঘর থেকে বের হচ্ছিলেন জান্নাত ও শহিদুল। এ সময় রুশদী বাবার হাত থেকে ছিটকে নিচে গড়িয়ে পড়ে। তাকে বাঁচাতে গিয়ে ওই দম্পতির গায়ে আগুন লেগে যায়। ততক্ষণে দাউ দাউ করে আগুন ধরে যায় রুশদির গায়েও। সে অচেতন হয়ে পড়ে যায়। একই পরিণতি হয় তার মা-বাবারও।
পূর্ত ভবনের প্রশাসনিক সেকশনে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কাজ করেন নিহত যূথীর বাবা জাহাঙ্গীর আলম। দিলু রোডের ওই বাড়ির ছাদে (ছয় তলায়) টিনশেড ঘরে মা-বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে থাকতেন যূথী। তিনি ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন।
যূথীর ভাই মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আপন জানান, ঘটনার সময় তারা সবাই ঘুমিয়ে ছিলেন। আগুন-আগুন চিৎকার শুনে সবাই এদিক-সেদিক ছুটতে থাকেন। ছাদ বেয়ে সবাই নামছিলেন। কিন্তু প্রাণ বাঁচাতে আতঙ্কগ্রস্ত যূথী ভুল করে নিচে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে তৃতীয় তলায় অচেতন হয়ে পড়েন। সেখানেই আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যান তিনি। আর ওপর থেকে তার বাবা ও আপন গ্রিল বেয়ে পাশের ভবনে লাফিয়ে নামার সময় দুজনেই সামান্য আহত হন। যূথীর মা লাল বানু নামার সময় পড়ে গিয়ে তার পা ও কোমরের হাড় ভেঙে যায়। তিনি পঙ্গু হাসপাতালে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন।
নিহত আব্দুল কাদেরের শ্যালক জহির আলম জানান, কাদেরের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার পশ্চিম নন্দনপুর গ্রামে। তার বাবার নাম মোহাম্মদ উল্লাহ (মৃত)। কাদের ওই ভবনের নিচতলায় অবস্থিত ‘ক্লাসিক ফ্যাশন’ নামে একটি বায়িং হাউসের অফিস সহকারী ছিলেন। তার স্ত্রী মরিয়ম বেগম দুই সন্তান রনি (২০) ও সোনিয়াকে (২২) নিয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকেন। কাদের তার কর্মস্থলেই নিচতলায় গ্যারেজের পাশে একটি কক্ষে থাকতেন।
হাতিরঝিল থানার এসআই খন্দকার সেলিম শাহরিয়ার জীবন জানান, মৃত তিনজনের মধ্যে শিশুসহ দুজন পুরোপুরি পুড়ে গেছে, যা দেখে শনাক্ত করার মতো নয়। তাই পোড়া দুজনেরই ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের জন্য নমুনা সংগ্রহ করতে ফরেনসিক বিভাগকে বলা হয়েছে। নিহত আব্দুল কাদেরের শরীর পুড়েনি। সম্ভবত ধোঁয়ায় শ্বাস বন্ধ হয়ে তিনি মারা গেছেন। অন্য কোনো দাবিদার না থাকায় দুই পরিবারের কাছে শিশু ও তরুণীর লাশ দুটি হস্তান্তর করা হয়েছে। লাশের ডিএনএ সংরক্ষণ করা হলে পরে কোনো সমস্যা হবে না। ঘটনাটি দুর্ঘটনা না অন্য কিছু তদন্তের পর বিস্তারিত জানা যাবে বলেও জানান তিনি।
Comment here