দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া ঠেকাতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ছয় শতাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তির পাসপোর্ট ইমিগ্রেশন ফরট্র্যাক সফটওয়্যারে ব্লক করেছে ইমিগ্রেশন পুলিশ। এসব ব্যক্তি দেশের তিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট হয়ে দেশত্যাগ করতে পারবেন না। এ তালিকায় রয়েছেন সাবেক মন্ত্রী-এমপি ছাড়াও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী ও দুর্নীতিগ্রস্ত দুই শতাধিক মেয়র, কাউন্সিলর ও ব্যবসায়ীর নামও রয়েছে। তাদের তথ্য ও ছবি তিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও সব ইমিগ্রেশন চেক পয়েন্টে দেওয়া হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলি চালানোর মদদদাতা, হুমুকদাতা ও মাঠে দায়িত্ব পালন করা সাবেক দুই আইজিপিসহ অর্ধশতাধিক আমলা ও পুলিশ কর্মকর্তার পাসপোর্টও ইমিগ্রেশন পুলিশের ফরট্র্যাক সফটওয়্যারে ব্লক করা হয়েছে।
তারাও দেশের বাইরে যেতে পারবেন না। এমনকী বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞার তালিকায় রয়েছেন সেলিব্রেটি অভিনেতা-অভিনেত্রীসহ গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বও। বিমানবন্দর, ইমিগ্রেশন অফিসসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, যাদের পাসপোর্ট ব্লক করা হয়েছে তাদের বেশিরভাগই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শেখ হাসিনা সরকারের সুবিধাভোগী ছিলেন। কেউ কেউ ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থানও নিয়েছিলেন।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সাড়ে তিন শতাধিক এমপি-মন্ত্রীর মধ্যে সরকারের পতন আঁচ করতে পেরে ৪৬ জন আগেভাগেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। বাকিদের পালিয়ে যাওয়া রোধে পাসপোর্ট ব্লক করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ ছাড়া তারা যেন সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে দেশ ছাড়তে না পারে, এ জন্য সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিকে সব সীমান্তে সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) এক শীর্ষ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, সাবেক মন্ত্রী, আমলা ও দুর্নীতিবাজদের হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে পলায়ন ঠেকাতে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। প্রত্যেক চেকপোস্টে এসব ব্যক্তির নাম-পরিচয়, পাসপোর্ট নম্বর ও ছবি দেওয়া আছে। সন্দেহভাজন কেউ বিমানবন্দরে এলে সঙ্গে সঙ্গে তাদের যাচাই-বাছাই করা হয়। প্রয়োজনে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়।
জানা গেছে, দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারেন এমন এমপি-মন্ত্রী, আমলা, পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) কেন্দ্রীয়ভাবে ফরট্র্যাক সফটওয়্যারে পাসপোর্ট ব্লকড করেছে, যেন দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও সীমান্তের চেকপোস্ট দিয়ে এসব দুর্নীতিগ্রস্ত দলদাসরা পালিয়ে যেতে না পারে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) জানিয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার বিজয় পরবর্তী পরিস্থিতিতে কতিপয় দুর্নীতিবাজ ও দুষ্কৃতকারী ব্যক্তিরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এমতাবস্থায় কেউ যাতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে না পারেন, সেজন্য সীমান্তে বিজিবির টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। দেশ ছেড়ে পালানোর সময় চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থেকে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. রজব আলী ও তার সহযোগী নাজমুল হোসেনকে আটক করে বিজিবি। যশোরের বেনাপোল থেকে আটক করা হয় ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার নতুন বান্দুরা গ্রামের সুনীল হালদারের ছেলে সজীব হালদারকে। এ ছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ সীমান্ত থেকে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা নিজামুল হোদাকে আটক করে বিজিবি।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিমানবন্দর ও সীমান্তের চেকপোস্ট দিয়ে কোনো কোনো মন্ত্রী-এমপি দেশ ছাড়ার চেষ্টা করেন। এ বিষয়টি আঁচ করতে পেরে পতনের পরপরই ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ৬ ঘণ্টার জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরকার পতনের পরের দিন গত ৬ আগস্ট শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক দেশ ছাড়ার চেষ্টা করেন। তবে বিমানবন্দর থেকে দুপুরে তাকে আটক করা হয়।
গত ৭ আগস্ট চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে এয়ার এরাবিয়ার ফ্লাইটে পালিয়ে যাওয়ার সময় আটক হন চট্টগ্রাম মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান আজিজ। গত ৮ আগস্ট দিবাগত রাত পৌনে ১টার দিকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা এবং কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া উপকমিটির সদস্য নুরুল আজিম রনিকে আটক করে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামে সংঘর্ষে জড়ানোর পর নুরুল আজিম রনি আলোচিত হন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরের দিন দেশ ছেড়ে পালানোর সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত এবং ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রিয়াজ মাহমুদকে বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয়।
জানা গেছে, সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, আনিসুল হক, হাছান মাহমুদ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মাইনুল হোসেন খান নিখিল, শেখ ফজলে শামস পরশ, মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলসহ সাড়ে তিন শতাধিক আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা কোনো ইমিগ্রেশন চেক পয়েন্ট দিয়ে আর বিদেশে যেতে পারবেন না। তাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে গুম, খুন ও দুর্নীতিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানোর জন্য নিজ নিজ বাহিনীর সদস্যদের ওপর নির্দেশনা প্রদান করেন পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন তথা র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক মো. হারুন অর রশিদ এবং ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান।
এদিকে, কয়েকজন অভিনেতা-অভিনেত্রীর পাসপোর্টও ব্লকড করা হয়েছে। তাদের দেশ ছাড়তে দেওয়া হচ্ছে না। এর মধ্যে চিত্রনায়ক রিয়াজকে গত ৬ আগস্ট রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয়। তিনি ঢাকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরে গেলেও তাকে ফেরত পাঠায় ইমিগ্রেশন পুলিশ। রিয়াজের এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ঢাকা থেকে দুবাই হয়ে যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার কথা ছিল। পাসপোর্ট ব্লকড তালিকায় রয়েছেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাবেক এক প্রভাবশালী নেত্রীসহ কয়েকজন অভিনেতা-অভিনেত্রী। এ ছাড়া দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার তালিকায় রয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, এ কে এম শহীদুল হক, র্যাবের সাবেক ডিজি মো. হারুন অর রশিদ ও সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা। এই তালিকায় আরও নাম রয়েছে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশীদ, ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হাফিজ আক্তার, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (কাউন্টার টেরোরিজম) আসাদুজ্জামান, যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) খন্দকার নুরুন্নবী, সনজিত কুমার রায়, যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) বিপ্লব কুমার সরকার, মেহেদী হাসান, মতিঝিল জোনের এসি গোলাম রুহানীসহ প্রভাবশালী আরও বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা।
পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন তথা র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক মো. হারুন অর রশিদ এবং ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানোর জন্য নিজ নিজ বাহিনীর সদস্যদের ওপর নির্দেশনা দেওয়ার অভিযোগে এরই মধ্যে মামলা হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তা ছাড়াও আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের সাবেক এবং বর্তমান অনেক নেতার পাসপোর্টও ব্লকড করা হয়েছে। দেশের সব সিটি করপোরেশনের মেয়র, কাউন্সিলর, সব পৌরসভার মেয়রের নামও ইমিগ্রেশনে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া উপজেলা চেয়ারম্যানদের নামও ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে পাঠানো হয়েছে। সরকার পতনের আগেই দেশ ছেড়ে পালান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নূর তাপস। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১২৯ জন কাউন্সিলরের মধ্যে শতাধিকই আত্মগোপনে চলে গেছেন। তারা যেন দেশত্যাগ করতে না পারেন, এ জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।
Comment here