নিজের অধীনে অডিট চায় রেলওয়ে - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

নিজের অধীনে অডিট চায় রেলওয়ে

তাওহীদুল ইসলাম : সরকারের বরাদ্দ করা অর্থ সরাসরি নিজেরা খরচ করতে পারে না রেলওয়ে। বরাদ্দকৃত অর্থ যাচাই-বাছাই শেষে ছাড় করে স্বতন্ত্র অর্থ ও হিসাব বিভাগ। আর্থিক স্বচ্ছতা রক্ষায় ব্যয়কারী সংস্থার কাছে টাকা রাখা হয় না। অনিয়ম ও দুর্নীতি ঠেকাতে জবাবদিহিতার স্বার্থে এ পদ্ধতি। অথচ রেলওয়ের আর্থিক কর্মকা- যথাযথভাবে পরিচালনায় সংস্থার অর্থ ও হিসাব বিভাগ দায়িত্বপ্রাপ্ত। তারা কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের অধীনে। ফলে রেল কোনো চাপ দিলে তা মানতে বাধ্য নন অর্থ ও হিসাব বিভাগের কর্মকর্তারা। এ ব্যবস্থার বিরোধিতা করছে রেলওয়ে।

রেলের নতুন অর্গানোগ্রাম পর্যালোচনায় দেখা গেছে, খরচের কোনো হিসাব নিয়ে আপত্তি করলে আছে বিপত্তি। কারণ এসিআর (বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন) নিতে হবে রেলের কাছ থেকে। এতে করে জবাবদিহিতা কমে যেতে পারে। এ নিয়ে রেল ও অডিট ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে রেলওয়ের অর্থ ও হিসাব বিভাগের কার্যক্রম নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। ফলে রেলওয়ের বেতন নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে জট।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রেলের অধীনস্থতা মানতে নারাজ অর্থ ও হিসাব বিভাগে কর্মরত অডিট ক্যাডারের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, রেলের টাকা খরচ করা সরকারি টাকা সঠিক ব্যবহার হচ্ছে কিনা- তা নজরদারি করাই তাদের কাজ। অর্থ ও হিসাব রেলের অধীনে যাওয়ার মানে, ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ থাকবে না। বদলি, পদায়ন ও এসিআর লেখার ক্ষমতা রেলের হাতে থাকলে, হিসাব বিভাগের কর্মকর্তারা রেলের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়বেন। নিজের চাকরি ও পদোন্নতি ঠিক রাখতে, রেলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা অনুযায়ী টাকা ছাড় করতে বাধ্য হবেন।

কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের কার্যালয় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ২৪ জুলাই চিঠি দেওয়া হয়েছে রেল মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে। ডেপুটি কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিনিয়র) মাহবুবুল হক স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, রেলওয়ের আর্থিক বিষয়াদিতে পরামর্শ প্রদানসহ যাবতীয় আর্থিক দাবি যথাযথ নিরীক্ষা ও যাচাইপূর্বক অর্থ ও হিসাব বিভাগের মাধ্যমে তা পরিশোধ ও হিসাবভুক্ত করা হয়। তাই স্বার্থের সংঘাত পরিহারের লক্ষ্যে ঐতিহাসিকভাবে রেলওয়ের অন্যান্য নির্বাহী বিভাগ থেকে অর্থ ও হিসাবকে পৃথক ও স্বতন্ত্র মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। সরকারের সব বিভাগের হিসাবরক্ষণ কার্যক্রমে হিসাব ব্যবস্থাপনার এ পদ্ধতি বিদ্যমান। কিন্তু ‘অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে, রেলওয়ের বহুল পরীক্ষিত ও ফলপ্রসূ এ আর্থিক ব্যবস্থাপনা পরিবর্তনের জন্য সাম্প্রতিক সময়ে রেলওয়ে থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অর্থ ও হিসাব বিভাগের জনবলকে রেলওয়ের অন্যান্য নির্বাহী বিভাগের মতো সংস্থাপন বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন করা। এ ছাড়া বিসিএস (অডিট অ্যান্ড একাউন্টস) কম্পোজিশন অ্যান্ড ক্যাডার রুলস অব ১৯৮০-এর সিডিউলভুক্ত অর্থ ও হিসাব বিভাগের ব্যবস্থাপনার পদ নাম পরিবর্তন ও রেলওয়ের নিয়োগবিধিতে তা অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ। এটি সরকারের রুলস অব বিজনেস, ১৯৯৬ অনুযায়ী সরকার কর্তৃক অনুসৃত পদ্ধতির ব্যত্যয়।

অডিট ক্যাডারের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনার কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা কম্পট্রোলার অ্যান্ড অটির জেনারেল রাষ্ট্রীয় অডিটর হিসাবে তার রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত করেন। এটি জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হয়। তাই আর্থিক শৃঙ্খলা পরিপন্থী কোনো কর্মকা- যেন না ঘটে সে বিষয়ে দৃষ্টি রাখা কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের সাংবিধানিক দায়িত্বের অংশ। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা ব্যতীত রেলওয়ের এ ধরনের উদ্যোগ নিতে পারে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি। বিদ্যমান বিধিগত অবস্থান উপেক্ষা করে রেলয়ের উদ্যোগ অনাকাক্সিক্ষত ও অপ্রত্যাশিত উল্লেখ করে রেলওয়ের আর্থিক ব্যবস্থাপনার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছে অডিটর সিএজি কার্যালয়।

একাধিক কর্মকর্তা জানান, সংশোধিত জনবল কাঠামোতে, নিজস্ব ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরও হিসাব বিভাগে বদলি সুযোগ রাখা হয়েছে। হিসাব বিভাগের কার্যালয় কমানো হয়েছে। এতে পে পয়েন্ট বন্ধ হওয়ায়, আগামী মাসে রেল কর্মীদের বেতন হবে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।

তবে গতকাল রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. হুমায়ুন কবির আমাদের সময়কে বলেন, বেতনের বিষয়টির সমাধান প্রায় হয়ে গেছে। এ নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না।

আর সংশোধিত জনবল কাঠামো ও অর্থ ও হিসাব বিভাগের সঙ্গে রেলের বিরোধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি জেনেছি দুই-তিন দিন হলো। ইতোমধ্যে আলোচনা হয়েছে। এটিরও সমাধান হয়ে যাবে।

রেল সূত্র জানায়, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে পরিচালন ব্যয় বাবদ ৩৭৬২ কোটি ও ৩৮৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। এ ছাড়া উন্নয়ন বাজেটে রেল পেয়েছে ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে যথাক্রমে ১২ হাজার ৫৭৫ কোটি এবং ১৪ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা। এ অর্থ প্রকৃতভাবে জনগণের সেবায় ব্যয় হচ্ছে কিনা তার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। এ আর্থিক কর্মকা- পরিচালনার দায়িত্বে অর্থ ও হিসাব বিভাগ। এ নিরীক্ষা ও যাচাই কাজ স্বাধীনভাবে করতে চায় অর্থ ও হিসাব বিভাগ।

১৮৫৮ সাল থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এ নিয়মে চলছে। মোদ্দা কথা, আর্থিক স্বচ্ছতা রক্ষায় ব্যয়কারী সংস্থার কাছে টাকা রাখা হয় না। যে বিভাগের কাছে টাকা থাকে, তাদের আবার খরচের এখতিয়ার নেই। এ কারণেই কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান নিজের হিসাব নিজে করে না। তা সিএজির অধীন অডিট ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কাজ। রেল চায় তাদের অধীনে থেকে কাজটি করাতে। রেলওয়েরও অর্থ ও হিসাব বিভাগ রয়েছে। কিন্তু রেলের নিজস্ব কর্মকর্তা নয়, সিএজির আদেশে বদলি ও পদায়ন হওয়া অডিট ক্যাডারের কর্মকর্তারা এ বিভাগে কাজ করেন। কিন্তু নতুন জনবল কাঠামোতে অর্থ ও হিসাব বিভাগের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়েছে রেলওয়ে। বদলির বদলে প্রেষণে অডিট ক্যাডারের কর্মকর্তাদের হিসাব বিভাগে চায় রেল। সংশোধিত জনবল কাঠামোতে, নিজস্ব ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরও হিসাব বিভাগে বদলি সুযোগ রাখা হয়েছে। হিসাব বিভাগের কার্যালয় কমানো হয়েছে।

গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর কার্যকর সংশোধিত জনবল কাঠামোতে এর বদল এনেছে রেল। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত এ কাঠামোতে দ্বিতীয় থেকে ২০ গ্রেড পর্যন্ত সব কর্মকর্তা কর্মচারীকে রেলওয়ে মহাপরিচালকের (ডিজি) অধীনে আনা হয়েছে। গত ২৫ মে ডিজির দপ্তরের আদেশে তা বলা হয়। এতে আরও বলা হয়, অর্থ ও হিসাব বিভাগের ১০ থেকে ২০ গ্রেডের কর্মচারীদের পদোন্নতি, বদলি ডিজির অনুমোদনে রেলের পার্সোনেল শাখার মাধ্যমে হবে।

এদিকে রেলওয়ে থেকে ২৯ জুন পাঠানো চিঠির ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছে অডিটরের কার্যালয়। বলা হয়, রেলওয়ে কর্তৃক যে ধরনের ভাষার প্রয়োগ করা হয়েছে এবং যেভাবে বিধিগত বিষয়ের অপব্যাখ্যার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে তা কাক্সিক্ষত নয়। শিষ্টাচারবহির্ভূতভাবে ভবিষ্যতে মহাপরিচালক বরাবর এ বিষয়ে পত্র প্রেরণ না করার জন্য অনুরোধ করা হলো মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। রেলওয়ের এ ধরনের মন্তব্য সরকার তথা অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষে অর্থ ও হিসাব বিভাগ কর্তৃক নিরপেক্ষভাবে কার্যক্রম পরিচালনায় বিরূপ প্রভাব ফেলবে, যা সরকারকে বিব্রত করতে পারে।

এ বিষয়ে রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের বক্তব্য জানতে ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। রেল ভবনে তার কার্যালয়ে যোগাযোগ করলে জানানো হয়, এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে রেলমন্ত্রী তার নির্বাচনী এলাকা পঞ্চগড়ে আছেন।

রেলওয়ের মহাপরিচালক ডিএন মজুমদার এ প্রসঙ্গে বলেন, সিএজি অফিসের সঙ্গে অর্গানোগ্রাম ও বেতন নিয়ে একটু অসুবিধা তৈরি হয়েছে। এটি সমাধানের পথে। তবে রেলের অন্য আরেকজন কর্মকর্তা জানান, অর্থ ও হিসাব বিভাগ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার অবসানে সংশোধিত অর্গানোগ্রাম আবারও সংশোধন করা হতে পারে।

 

Comment here