নিত্যপণ্যের দাম আর না বাড়ালে হয় না - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

নিত্যপণ্যের দাম আর না বাড়ালে হয় না

মোতাহার হোসেন : নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে দিশাহারা দেশের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত। চাল, ডাল, তেল, মাছ, মাংসসহ সব নিত্যপণ্যের দাম প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বাজার তদারকি ও মনিটরিংয়ের অভাবেই অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্যমূল্য অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি করছে- এমন অভিযোগ ভোক্তাদের। অন্যদিকে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দামও বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলছে। এ অবস্থায় এসব সেবাপণ্যের দাম বৃদ্ধি করলে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্তদের আরও বিপদের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে মর্মে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক যুগে দেশের বাজারে চালের দাম তো বাড়ছেই। একই সঙ্গে কয়েকগুণ মূল্য বেড়েছে প্রায় সব নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যেরও। এ অবস্থায় মানুষের আয় ও ব্যয়ের সমন্বয় হচ্ছে না। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে মধ্যবিত্ত সংকটে পড়েছে। আবার এরই মধ্যে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবিত সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। একইভাবে রাজধানীতে বাসাভাড়া বৃদ্ধি পাবে- এমন আশঙ্কা নগরবাসীর। এ নিয়ে একাধিক মন্ত্রী স্বীকার করেছেন, নিয়ন্ত্রণহীন বাজারদরে দারুণ কষ্টে আছে মানুষ।

আর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্বাভাবিক রাখতে টিসিবির মাধ্যমে ৬টি নিত্যপণ্য খোলাবাজারে বিক্রিরসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানান বাণিজ্যমন্ত্রী। রাজধানীর অন্যতম পাইকারি বাজার কারওয়ান বাজার থেকে শুরু করে তেজগাঁও- সবখানেই জিনিসপত্রের দাম নিয়ে মানুষের হতাশার কথা ফুটে উঠেছে। ক্রেতার নাভিশ্বাস কথাটা সবার কাছে পরিচিত ছিল এতদিন। এখন বিক্রেতারাও বলছেন নাভিশ্বাস উঠে গেছে তাদের। তিনবেলা খাবারের জন্য দরকারি এমন কোনো পণ্য নেই- যার দাম কমেছে, বরং প্রতিদিনই বাড়ছে খাদ্য ও নিত্যপণ্যের দাম। অভিযোগ রয়েছে, ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে এভাবে নিয়ন্ত্রণহীন করেছে বাজারদর। তা ছাড়া, সরকারের বাজার মনিটরিং সিস্টেম পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে আছে।

দ্রব্যমূল্যের তুলনায় দেখা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি বিপণন অধিদপ্তর প্রতিদিন ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম প্রকাশ করে। এতে দেখা গেছে, ২০০৯ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকার এক বাজারে এক কেজি সরু বোরো চালের দাম ছিল ৩৪-৩৬ টাকা। ২০২১ সালের ১০ নভেম্বর একই বাজারে ওই চালের দাম ছিল ৫৭-৫৮ টাকা। আর ২০২২ জানুয়ারিতে ওই চাল ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। মোটা বোরো চালের দাম ২০০৯ সালে ছিল ২১-২৩ টাকা। ২০২১ সালে ছিল ৪০-৪৫ টাকা। আর ২০২২ জানুয়ারিতে ওই চাল ৪৮ থেকে ৫০ টাকা। ২০০৯ সালে এক কেজি দেশি মসুর ডালের দাম ছিল ৭৫-৮০ টাকা। ২০২১ সালে ৯০-১০০ টাকা। আমদানিকৃত মসুর ডালের দাম ২০০৯ সালে ছিল ৫০-৫৫ টাকা। ২০২১ সালে সেটি হয় ৮০-৮৫ টাকা। মুগ ডালের দাম ২০০৯ সালে ছিল ৮৫-৯০ টাকা। ২০২১ সালে সেটি বেড়ে হয় ১০০-১১০ টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে তা বিক্রি হয় ১২০-১২৫ টাকায়।

২০০৯ সালে এক কেজি আটার দাম ছিল ২৫-২৬ টাকা। ২০২১ সালে ৩৫-৩৬ টাকা। ২০০৯ সালে এক কেজি ময়দার দাম ছিল ৩৪-৩৬ টাকা। ২০২১ সালে ৪৫-৫০ টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রতি কেজি ময়দা ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। অনুরূপ এক কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম ২০০৯ সালের ১০ নভেম্বর ছিল ৪০-৪৪ টাকা। ২০২১ সালে সেটি বিক্রি হয় ৫৫-৬০ টাকায়। চলতি বছরে জানুয়ারিতে ওই পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৩০-৩৫ টাকায়। ১৮ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬০ টাকায়। আর আমদানিকৃত পেঁয়াজের দাম ২০০৯ সালে ছিল ২৮-৩৪ টাকা। ২০২১ সালে ৪৫-৫০ টাকা। চলতি বছরে জানুয়ারিতে বিক্রি হয় ৪৫-৫০ টাকায়। ১৮ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ বেড়ে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকায়। ২০০৯ সালে এক কেজি দেশি রসুনের দাম ছিল ৯০-১০৫ টাকা। ২০২১ সালে সেটি কম ছিল ৫০-৭০ টাকা। আমদানিকৃত রসুনের এক কেজির দাম ২০০৯ সালে ছিল ৮০-৮৫ টাকা। ২০২১ সালে সেটি বেড়ে হয় ১১০-১২০ টাকা।

২০০৯ সালে এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৭০-৭৩ টাকা। ২০২১ সালে সেটি বিক্রি হয়েছে ১৩৮-১৪২ টাকায়। চলতি বছর ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে বিক্রি হচ্ছে ১৬০-১৬৮ টাকায়। ২০০৯ সালে আমদানিকৃত এক কেজি চিনির দাম ছিল ৫২-৫৪ টাকা। ২০২১ সালে ৭৫-৭৭ টাকা। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৮৫ থেকে ১০০ টাকায়। ২০০৯ সালে দেশি মুরগির ডিম ছিল ৩২-৩৪ টাকা হালি। ২০২১ সালে সেটি বিক্রি হয়েছে ৫৫-৬০ টাকায়। ফার্মের মুরগির ডিমের (লাল) দাম ২০০৯ সালে ছিল ২৫-২৬ টাকা। ২০২১ সালে ৩৬-৪০ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪৪ টাকায়। গরুর মাংসের কেজিপ্রতি দাম ২০০৯ সালে ছিল ২২০-২৩০ টাকা। ২০২১ সালে সেটি বিক্রি হয়েছে ৫৮০-৬০০ টাকায়। এখন প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৬২০-৬৫০ টাকায়।

গত ১২ বছর ১৪ বার পানির দাম বাড়িয়েছে ঢাকা ওয়াসা। ২০০৯ সালে আবাসিক গ্রাহকদের জন্য প্রতিইউনিট (১ হাজার লিটার) পানির দাম ছিল ৫ টাকা ৭৫ পয়সা। গত বছরের জুলাই থেকে ১৫ টাকা ১৮ পয়সা দরে দাম দিতে হচ্ছে। অর্থাৎ গত ১২ বছরে ইউনিটপ্রতি পানির দাম প্রায় ১০ টাকা বেড়েছে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ও ভোক্তাকণ্ঠ আয়োজিত এক ওয়েবিনারের মূল নিবন্ধে বলা হয়, ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত গত ১১ বছরে বিদ্যুতের দাম ১০ বার বেড়েছে। পাইকারি বিদ্যুতের দাম ১১৮ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। আর খুচরা পর্যায়ে দাম বেড়েছে প্রায় ৯০ শতাংশ।

গত বছরের ৩ নভেম্বর রাতে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়। ডিজেলের মোট চাহিদার ৬৩ শতাংশ ব্যবহৃত হয় পরিবহন খাতে। আর সেচকাজে ব্যবহৃত হয় ১৬ শতাংশ। ৪ নভেম্বর ফার্নেস অয়েলের দাম লিটারপ্রতি ৩ টাকা বাড়িয়ে ৬২ টাকা করা হয়। আরও বেড়েছে বেসরকারি খাতের তরলিকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম। ১২ কেজির সিলিন্ডারে বেড়েছে ৫৪ টাকা।

ক্যাব জানায়, ২০২০ সালে (সর্বশেষ জরিপ) ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং সেবা সার্ভিসের দাম বেড়েছে ৬ দশমিক ৩১ শতাংশ। ২০১৯ সালে এটি ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ ও ৬ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। ২০১৮ সালে তা ছিল ৬ শতাংশ ও ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ। ঢাকার ১৫টি খুচরা বাজার ও বিভিন্ন সেবা সার্ভিসের মধ্য থেকে ১১৪টি খাদ্যপণ্য ও ২২টি নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী এবং ১৪টি সেবা সার্ভিসের সংগৃহীত মূল্য বিশ্লেষণ করে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে ক্যাব। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে ২০০৯-১০ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ৮৪৩ মার্কিন ডলার। আর সবশেষ হিসাব বলছে, মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৬৫৪ ডলার। তবে এই আয়ের সুষম বণ্টন হচ্ছে বলে মনে করেন না অনেক অর্থনীতিবিদ। কারণ একদিকে যেমন একদল মানুষ দ্রুত ধনী হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি গরিবের সংখ্যাও বাড়ছে।

করোনার সময় প্রায় সোয়া তিন কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে বলে সম্প্রতি এক জরিপে বলা হয়। আমাদের প্রত্যাশা- করোনাকালে ভর্তুকি দিয়ে হলেও ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবিত সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে সরকার। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ও জ্বালানি তেলে দাম বৃদ্ধি না করে এসব ক্ষেত্রে দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থা, অপচয় বন্ধ করা জরুরি। তা হলে এসব ক্ষেত্রে সরকারকে ভর্তুকিও দিতে হবে না। এসব করা না হলে মানুষের কষ্ট ও জীবনযাত্রা- দুটিই বাধাগ্রস্ত হবে। এ ছাড়া বাড়বে ক্ষোভ ও অসন্তোষ। নিশ্চয় এটি শেখ হাসিনার সরকারের জন্য, মানুষের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। সে জন্য সাধারণ জনগণের কথা ভেবে নিত্যপণ্যের দাম আর না বাড়ানোই উচিত।

 

 

Comment here