নিত্যপণ্যের বাজারে জিম্মি ভোক্তা - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

নিত্যপণ্যের বাজারে জিম্মি ভোক্তা

নিত্যপণ্যের বাজারে দামের দৌরাত্ম্যে রীতিমতো জিম্মি হয়ে পড়েছেন ভোক্তারা। হু হু করে বাড়ছে একের পর এক পণ্যের দাম। আজ পেঁয়াজের দাম বাড়ছে, তো কাল বাড়ছে সয়াবিন তেলের দাম। এ দুয়ের দামের সঙ্গে দৌড়াতে গিয়ে যখন যাচ্ছেতাই দশা ভোক্তার, তখন দেখা গেল, গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো হুট করেই বেড়ে গেল চিনির দাম। সেটা সামাল দিতে যখন ভোক্তার নাভিশ্বাস, তখন হয়তো বেড়ে গেল ডিম আর মুরগির দাম কিংবা চাল, মরিচ, আলু বা সবজির দাম। সেই দামের ঘোড়া একবার ঊর্ধ্বমুখী হলো তো হলোই; নামার নাম নেই। এদিকে পরিবারের ব্যয় সামলাতে গিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছে স্বল্প আয়ের মানুষ, যারা এমনিতেই রয়েছে উচ্চমূল্যস্ফীতির চাপে।

বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক থাকার পরও পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। এ যেন লাগামহীন এক পাগলা ঘোড়া- গড়ছে একের পর এক উচ্চমূল্যের রেকর্ড। ভোক্তাদের অভিযোগ, সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে আসাধু ব্যবসায়ীরা। ভোক্তাদের পকেট কাটতে তৈরি করা হচ্ছে কৃত্রিম সংকট। এভাবে অর্থলোভী চক্র অসহায় ভোক্তাকে জিম্মি করে হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার কোটি টাকা। এ রীতিমতো ছিনতাই। বারবার একই অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে তারা। তাই বেপরোয়াও বটে।

advertisement

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোকে নিয়ে বারবার কারসাজি হলেও এ থেকে পরিত্রাণ মিলছে না। যে কোনো একটি পণ্যের দাম রাতারাতি বেড়ে রেকর্ড গড়ে; স্বল্প সময়ের মধ্যেই কারসাজিকারীরা মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। বিভিন্ন পণ্যে প্রতিবার একই কা-ের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে; ভোক্তার পকেট কাটা যাচ্ছে। কিন্তু সিন্ডিকেট চক্রের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। সরকারি দু-একটি সংস্থা কোনো কোনো ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে নামমাত্র জরিমানা করছে। এতে হিতে বিপরীত হচ্ছে। জরিমানার অর্থ তুলতে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম আরও বাড়িয়ে দিচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে- ভোক্তার স্বার্থরক্ষায় সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে কে? সরকারের চেয়ে সিন্ডিকেট কি বেশি শক্তিশালী? এমন প্রশ্নও উঠছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যগুলোতে যে সিন্ডিকেট হচ্ছে সেটা পরিষ্কার। বাজারে বড় বড় খেলোয়াড় আছে যারা পণ্যের জোগান দিচ্ছে, তাদের হাতেই বাজারের নিয়ন্ত্রণ এবং পণ্যমূল্য নির্ধারণে তাদের ভূমিকাটাই প্রধান। পণ্যের দাম হঠাৎ বেড়ে যাচ্ছে আবার কমে। আর এর মধ্য দিয়ে বাজার থেকে বড় একটি অঙ্ক এসব সিন্ডিকেটের পকেটে চলে যায়। এখানে জোগানের সংকট, হঠাৎ চাহিদা বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাজার কিংবা ডলারের দাম মুখ্য নয়। এখানে মূলত কারসাজি করা হচ্ছে। প্রতিযোগিতামূলক না হওয়ায় কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠানের হাতেই জিম্মি হয়ে আছে বাজার।

সম্প্রতি বাজারে ডিমের দাম আকাশচুম্বী হলে বাজারে বিশেষ অভিযানের পাশাপাশি ডিম উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। বাজার তদারকিতে বরাবরের মতো উঠে আসে কারসাজি ও নানা অনিয়মের তথ্য। খামারি পর্যায়ে কম দামে বিক্রি হলেও বাজারে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অতিরিক্ত ৩ টাকা দাম বেড়ে যাচ্ছে। বড় কোম্পানির ডিলার এজেন্টরা ফোনের খুদেবার্তা ও ফেসবুক পেজে দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে, সে দামেই বিক্রি হচ্ছে। কারসাজি আড়াল করতে ক্রয়-বিক্রয়ে পাকা রসিদ রাখা হচ্ছে না। এর আগেও ডিম ও মুরগি নিয়ে এমন কারসাজি হয়েছে। রাতারাতি দাম বেড়ে রেকর্ড ভাঙে ডিম ও মুরগি। সে সময়ও অল্প সময়ে বিপুল অর্থ লোপাট হয়েছে।

কিছুদিন আগেও কাঁচা মরিচ নিয়েও হয়েছে লঙ্কাকা-। সিন্ডিকেটের থাবা থেকে বাদ পড়েনি গরিবের আলু পর্যন্ত। সরকারি সংস্থার অনুসন্ধানেই উঠে এসেছে যে, ভালো উৎপাদন ও মজুদ থাকা সত্ত্বেও কৃষকের হাতে আলু ফুরাতেই হিমাগারগুলোতে দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানো হয়েছে। দাম বাড়লেও কৃষকরা লাভবান হননি। বেশি দামে বিক্রি করে অতিরিক্ত মুনাফা করছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। একইভাবে পেঁয়াজ, তেল, চাল, আদা, চিনি নিয়েও চলে কারসাজি। সরকার অনেক পণ্যের দাম বেঁধে দিলেও বাজারে তা উপেক্ষা করে বেশি দামেই বিক্রি হয়। অপরদিকে অনেক পণ্যে আমদানি সুবিধা, শুল্ক ছাড় দেওয়া হলেও তার সুফল কেবল ব্যবসায়ীরাই ভোগ করে। বঞ্চিত থেকে যায় ভোক্তারা।

রাজাধানীর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বেশির ভাগ পণ্যের দামেই এখন আগুন জ্বলছে। এর মধ্যে পেঁয়াজের দামটা আবারও বাড়ছে। প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৮০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রসুনের দামটাও বেড়ে ২২০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আদা, হলুদসহ অন্যান্য মসলা পণ্যের দামও কিনতে হচ্ছে হিসাব করে।

মাঝারি বিআর-২৮ চাল কিনতেও খরচ হচ্ছে ৬০ টাকা পর্যন্ত। গরিবের খোলা আটার কেজি ৫০ টাকার ওপরে রয়েছে। এঙ্কর ডালের কেজিও ৭৫ টাকা ছুঁয়েছে। সস্তার পাঙাশ মাছ কিনতে এখন মধ্যবিত্তদেরও কষ্ট হচ্ছে। সহজলভ্য এই মাছটি ২০০ টাকার নিচে মিলছে না। অপরদিকে তেলাপিয়ার কেজিও ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা হয়েছে। তরিতরকারির দামেও স্বস্তি মিলছে না। দামের উত্তাপে বেশির ভাগ সবজিতে হাত ছোঁয়ানোই দায় হয়ে পড়েছে। সামান্য আলু কিনতেও কেজিপ্রতি গুনতে হচ্ছে অন্তত ৪০ টাকা।

প্রোটিনের সহজলভ্য উৎস ফার্মের ডিম ও ব্রয়লার মুরগিও এখন আর গরিবের নাগালে নেই। মধ্যবিত্তরাও কিনছেন অঙ্ক কষে। ডিমের হালি এখনও ৫০ তেকে ৫৫ টাকা, আর ব্রয়লারের কেজি ১৮০ টাকা। কাঁচা মরিচের দাম কমলেও বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকার আশপাশে। সয়াবিনের দাম কমানো হলেও প্রতি লিটার কিনতে গুনতে হচ্ছে ১৭৫ টাকা।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যও বলছে, গত এক বছরে বাজারে আটা, ডাল, চিনি, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, মসলাপণ্য, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, তরিতরকারি, কাঁচামরিচ, এমনকি সামান্য লবণের দামটাও অনেকখানি বেড়েছে।

রাজধানীর বাসাবো এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি চাকিজীবী মো. কৌশিক আহমেদ বলেন, বাজারের হিসাব রাখা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। আজ এক পণ্যের দাম তো কাল আরেক পণ্যের দাম রাতারাতি বেড়ে আকাশচুম্বী হয়। ব্যবসায়ীরা যোগসাজশ করে এটা করছে অথচ এ থেকে মুক্তি পাচ্ছি না। আমরা যেন বাজারে জিম্মি হয়ে আছি। দাম যতই বাড়–ক, কিছুই করার নেই। কিনে খেতে হচ্ছে।

কদমতলী এলাকার বাসিন্দা খেটে খাওয়া দিনমজুর মো. মোতাহার বলেন, সামান্য আয়ের প্রায় সবটুকুই সংসারের বাজারের পেছনে খরচ হয়ে যায়। বাড়িভাড়া, পোশাক, চিকিৎসাসহ অন্যান্য খরচে টান পড়ে যায়। বাজারে গেলে নিজেকে অসহায় লাগে।

বাজারে কেবল ভোক্তারা নয় সরকারও অসহায় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি নীতিনির্ধারকদের বক্তব্যে মনে হয় যে, সরকারও অসহায়। সরকারের চেয়েও যেন শক্তিশালী এই সিন্ডিকেটগুলো। বলা হচ্ছে বড়দের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে বাজার পরিস্থিতি; বিশেষ করে সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। কিন্তু কেউ তো বলছে না যে এদের জেলে দেওয়া হোক, প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হোক। তার বদলে কারসাজির সঙ্গে জড়িত থাকলে তাদের নীতি সহায়তাগুলো বন্ধ করে দিতে পারে সরকার। সরকারকে আরও কঠোর হতে পারে।

ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এএইচএম সফিকুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, বাজারে অসাধু ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পণ্যের বাজার অস্থির করে তুলছে। আমরা বাজারে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। অভিযানে অনিয়ম পেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসছি আমরা। সার্বিক পরিস্থিতি জানিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদনও দেওয়া হয়। এর বাইরে আমাদের হাতে কিছু নেই। আমাদের জনবল স্বল্পতা সত্ত্বেও সর্বোচ্চটুকু করছি।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান আমাদের সময়কে বলেন, প্রতিযোগিতামূলক বাজারের অভাবে বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে যে পদক্ষেপগুলো দেখতে পাই সেটা অনেকটা ‘অগ্নিনির্বাপণ’-এর মতো। যেখানে আগুন লাগে সেখানে তাৎক্ষণিকভাবে পানি ছেটানো। এতে একটা সময় দাবানলের মতো আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আগুনটা যেন না লাগে সেই সমাধান বের করতে হবে আগে। আজ একটা পণ্য, কাল আরেকটা পণ্যের দাম সিন্ডিকেট বাড়িয়ে দেবে আর সেদিকে ছুটব, সেটা সমাধান হতে পারে না। সিন্ডিকেট কোথায় কোথায় হচ্ছে সে তথ্য বেরিয়ে আসছে। সুতরাং স্থায়ী সমাধানের পথ বের করতে হবে।

এদিকে কোন পণ্যের বাজার অস্থির হয়ে পড়লে সর্বশেষ অস্ত্র হিসেবে আমদানির হুশিয়ারি কিংবা অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। এতে হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে দাম কমেও আসছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ব্যবসায়ীরাও জানেন আমাদের ডলার সংকট রয়েছে। সুতরাং এটা কার্যকরী পদক্ষেপ নয়। তা ছাড়া আমদানির অনুমতি দিলে সেখানেও বড় ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করবেন। সেখানেও যে সিন্ডিকেশন হবে না তার নিশ্চয়তা কি। প্রভাবশালী সিন্ডিকেটই যদি আমদানির অনুমতি পেয়ে যায় তাহলে তো হিতে বিপরীত হবে। উল্টো অর্থপাচারের নতুন সুযোগ তৈরি হতে পারে।

ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা আরেক সংগঠন কনশাস কনজ্যুমার্স সোসাইটি (সিসিএস) এর নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ বলেন, বাজারে দাম বাড়লেও উৎপাদনকারীরা লাভবান হচ্ছেন না। তাদের ঠকিয়ে ভোক্তারও পকেট কাটছে সিন্ডিকেট চক্র। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিষ্ফল বৈঠক আর সচেতনতা বৃদ্ধি করে এই সিন্ডিকেট ঠেকানো যাবে না। কারসাজিকারীরা চিহ্নিত হলেও শাস্তি হয় না। শুধু জরিমানায় হবে না। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক সদিচ্ছাও থাকতে হবে।

Comment here