নির্বাচন

নির্বাচন প্রত্যাখ্যান, কাল সকাল-সন্ধ্যা হরতাল বিএনপির

নিজস্ব প্রতিবেদক : বিভিন্ন অভিযোগ এবং ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির ৬৯টি ওয়ার্ডের বিভিন্ন কেন্দ্রের অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি। এ ছাড়া আগামীকাল রোববার রাজধানীতে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দিয়েছে দলটি।

আজ শনিবার রাতে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নির্বাচন প্রত্যখ্যান ও হরতাল কর্মসূচির ডাক দেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ঢাকাবাসীকে শান্তিপূর্ণভাবে এই হরতাল কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানান তিনি।

বিএনপির অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে-

*নৌকা ব্যাজ পরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ভোট কেন্দ্র দখল,

*কেন্দ্রের ভেতর ফিঙ্গার প্রিন্ট দেওয়ার পর গোপনবুথে নৌকাপ্রতীকে ভোট দিয়ে দেওয়া,

*ইভিএমের ত্রুটি ও এর রিমোর্ট ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের হাতে থাকা,

*প্রার্থী ও পোলিং এজেন্টদের উপর হামলা ও ভোট কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা,

*ভোট কেন্দ্রের সমানে বহিরাগতদের জড়ো করে বোমা বিষ্ফোরণ ও ভোটারদের আতঙ্কিত করা।

ভোট গ্রহণ শেষে বিকেলে ওয়ার্ডগুলো থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অভিযোগ গুলো তুলে ধরেন বিএনপি মহাসচিব। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির ৬৯টি ওয়ার্ডের বিভিন্ন কেন্দ্রের এসব অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে নির্বাচনের নামে তামাশা হয়েছে। বিভিন্ন কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের হামলায় ৪১ জন বিএনপি নেতাকর্মী আহত হয়েছেন।’

এ সময় নির্বাচনের ফলাফর প্রত্যাখ্যান করে বিএনপির পক্ষে রাজধানীতে আগামীকাল সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দেন তিনি।

বিএনপি মহাসচিব অভিযোগ করে জানান, উত্তরের ৯নম্বর ওয়ার্ডের সব কেন্দ্র থেকে ধানের শীষের পোলিং এজেন্টদের আওয়ামী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা পুলিশের সহযোগিতায় মারধর করে বের করে দিয়েছে। সিদ্ধান্ত হাইস্কুল কেন্দ্রের এজেন্ট ইব্রাহিম মোল্লাকে মারধর করে মাঠের মধ্যে কাপড়-চোপড় ছিঁড়ে দাঁড় করিয়ে রাখে। তার স্ত্রীকে একটি খালি কক্ষে আটকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়। এ ওয়ার্ডে হামলায় কাউন্সিলর প্রার্থীর ভাই সাইফুল ইসলাম মিন্টু ও বিএনপি নেতা রফিকের অবস্থা গুরুতর। ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের হামলায় বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থী হাবিবুর রহমান রাব্বি ও তার স্ত্রীসহ ২২ জন আহত হয়েছেন। হামলায় ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে যুবদল নেতা জালাল আহত হয়েছেন।

আরও অভিযোগ তুলে ফখরুল জানানন, তাবিথ আউয়ালের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের গাড়ি বহরকে লক্ষ্য করে ৫টি ককটেল নিক্ষেপ করা হয়। ১০ নম্বর ওয়ার্ডে আর্সি স্কুল কেন্দ্রে আওয়ামী সন্ত্রাসী মিরাজের নেতৃত্বে বিএনপি নেতা মামুনের উপর হামলা করা হয়েছে। কবি নজরুল স্কুল কেন্দ্রে জহিরুল ইসলাম জহিরের উপর হামলা করে ধানের শীষের এজেন্টদের বের করে দিয়েছে। দারুস সালাম স্কুল ভোট কেন্দ্র থেকে স্থানীয় এমপির লোকজন পুলিশের সহযোগিতায় ধানের শীষের এজেন্টদের বের করে দিয়েছে। লালকুটি কেন্দ্রে ধানের শীষের এজেন্ট লুৎফর রহমান বিজয়কে টয়লেটে আটকে রেখে মারধর করে গুরুতর আহত করে। তার অবস্থা সংকটাপন্ন।

তিনি আরও জানান, ২ নম্বর ওয়ার্ডের পল্লবী মহিলা ডিগ্রি কলেজ ও লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল কেন্দ্র থেকে সব এজেন্টদের মারধর করে বের করে দিয়েছে। পুণরায় প্রবেশ করতে গেলে পল্লবী থানা যুবদল সভাপতি পিন্টুকে রড দিয়ে বেদম পেটানো হয় এবং দা দিয়ে মাথায় কোপ দেওয়ার চেষ্টা করে। তিনি হাত দিয়ে ঠেকাতে গেলে হাত কেটে যায়। এছাড়া উত্তরের ১ নম্বর ওয়ার্ড, ২, ৩, ৭, ৮, ১১, ১২, ১৫, ১৮, ২৪, ৪০, ৬, ১৭, ১৯ ২২, ২৩, ২৬, ৩৩, ৪৭, ৫১ নম্বর ওয়ার্ডের সব কেন্দ্র থেকে মারধর করে ধানের শীষের এজেন্টদের বের করে দেওয়া সহ নানা অভিযোগ করেন মির্জা ফখরুল।

তিনি আরও জানান, উত্তরের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে দরগাহ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, হযরত শাহ আলী উচ্চ বিদ্যালয়, মনিকানন উচ্চ বিদ্যালয়সহ মোট ১৪টি কেন্দ্র আওয়ামী সন্ত্রাসীরা তাদের দখলে নিয়েছে। এছাড়া আওয়ামী সন্ত্রাসীদের সহযোগিতায় সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারগণ সাধারণ ভোটারদের আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে নৌকায় চাপ দিতে বাধ্য করছে। ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে ধানের শীষের এজেন্টদের বের করে দেওয়া ছাড়াও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা তাসলিমা আজাদীর বাসায় হামলা চালিয়ে বাসার আসবাবপত্র ভাংচুর ও পরিবারের সদস্যদের ভয়ভীতি দেখায়।

ফখরুল বলেন, ‘উত্তরের মতো ঢাকা দক্ষিণেও প্রায় একই অবস্থা। দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলা ও ভোট কারচুপি করেছে।’ তিনি জানান, ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে জরিনা শিকদার হাইস্কুল কেন্দ্রের গেট থেকে ধানের শীষের এজেন্ট রাজিব হোসেন, আনোয়ার হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে গভ: ল্যাবরেটরি হাইস্কুল কেন্দ্র থেকে বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী জাহাঙ্গীর হোসেন পাটোয়ারীসহ এজেন্টদের মারধর করে ভোট কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। আহত ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন ও কাউন্সিলর প্রার্থী জাহাঙ্গীর হোসেন পাটোয়ারীর ভাই ওয়ার্ড বিএনপির সহসভাপতি হুমায়ুন পাটোয়ারী এবং তার মেয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ সময় দায়িত্বরত পুলিশের কাছে সাহায্য চাইলেও তারা নির্বিকার থাকে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বিএনপির মহাসচিব আরও জানান, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা লিটল এ্যাঞ্জেল স্কুল কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে ভাংচুর মারধর করায় বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থী মীর আশরাফ আলী আজমসহ ২ জন নেতা গুরুতর আহত হন। ২ নম্বর ওয়ার্ডে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নেতৃত্বে এলাকায় সশস্ত্র মহড়া ও হামলা চালিয়ে ধানের শীষের এজেন্ট সানি, সাজ্জাত ও নজরুলের উপর হামলা করা হয়েছে। ৪০ নম্বর ওয়ার্ডে গোপীবাগ মিতালী স্কুল থেকে ধানের শীষের এজেন্টদের মারধর করে রক্তাক্ত করেছে এবং কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে।

২০ নম্বর ওয়ার্ডে একজন এজেন্টের গায়ে গরম পানি ঢেলে দেওয়া হয়েছে। এজেন্ট শাহবুদ্দিনকে বেধড়ক পেটানো হয়েছে। এ ওয়ার্ডে বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী সৈয়দ রফিকুল ইসলাম স্বপনকে বিভিন্ন প্রবেশে বাধা দেয়া হয়েছে। বিএনপি কর্মী খলিলুর রহমানকে মারধর করে গুরুতর আহত করা হয়েছে। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

দক্ষিণের ৬, ১৩, ২২, ২৫, ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৯, ৪০, ৪১, ৪২, ৪৩, ৪৪, ৪৮, ৪৯, ৫৩, ৬৮ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে ধানের শীষের পোলিং এজেন্ট বের করে দেওয়া, বাধা দেয়াসহ নানা অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ করেন মির্জা ফখরুল। তিনি জানান, ৪০ নম্বর ওয়ার্ডে মাদারটেক আব্দুল আজিজ স্কুল অ্যন্ড কলেজ কেন্দ্রে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালায় আওয়ামী লীগ। এ সময় উপস্থিত সাংবাদিকরা ছবি তুলতে গেলে ক্যামেরা ও মোবাইল ফোন আওয়ামী লীগ কর্মীরা কেড়ে নেয় এবং সাংবাদিকদের উপর হামলা করে। এছাড়া শাহ সাহেব লেনে সেন্ট জোসেফ টেকনিক্যাল স্কুল কেন্দ্রে কিরন নামে একজন ভোটার জানান তাদের ভোট হয়ে গেছে। ভোট দিতে গিয়ে তারা ফেরত এসেছেন।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘সকাল শুরু হয়েছে একটা বড় রকমের বিধি লঙ্ঘনের মধ্য দিয়ে। সেটি হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী সিটি কলেজে ভোট দিতে গিয়ে তিনি যে বক্তব্য রেখেছেন তা সরাসরিভাবে নির্বাচনের হস্তক্ষেপের শামীল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভোট প্রদান করে সকালে গণমাধ্যমে নৌকা মার্কায় ভোট দেয়ার আহ্বান জানান। যা নির্বাচন বিধির মধ্যে পড়ে না এবং যা নির্বাচনী আচরণবিধির সম্পূর্ণ পরিপন্থি।’

ফখরুল আরও বলেন, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার গণমাধ্যমে বলেছেন, “এজেন্টদের টিকে থাকার সামর্থ থাকতে হবে”। এজেন্টদের তিনি প্রতিরোধে গড়ে তোলার পরামর্শ দেন। এই কথা বলে তিনি সরকার দলীয় সন্ত্রাসীদের উস্কে দিয়ে সংঘাতের দিকে যাওয়ার ইন্ধন দিয়েছেন।’

বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, ‘অনেক কেন্দ্রে ইভিএমে ধানের শীষের প্রতীক ছিল না। ফলে ভোটাররা ভোট প্রদান করতে পারেননি। অনেক কেন্দ্রে ভোটারদের আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে সনাক্তকরণের পর ভোট না দিতে দিয়েই কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়েছে। অনেক কেন্দ্রে ভোটারের সাথে ভোট কক্ষে ঢুকে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে ভোট দিতে বাধ্য করা হয়েছে।’

ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তরের ধানের শীষের মেয়র প্রার্থী ও তাদের প্রধান নির্বাচনী এজেন্টরা শত শত অভিযোগ রিটার্নিং অফিসার ও নির্বাচন কমিশনের প্রেরণ করলেও তা প্রতিকারে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে জানান বিএনপি মহাসচিব।

নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ভাইস  চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, হাবিব উন নবী খান সোহেল প্রমুখ।

Comment here

Facebook Share