বিমানের ইঞ্জিন গায়েব, পড়ে আছে কঙ্কাল - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

বিমানের ইঞ্জিন গায়েব, পড়ে আছে কঙ্কাল

গোলাম সাত্তার রনি : ডাম্পিং স্টেশনগুলোয় পুলিশ, কাস্টমস বা অন্য কোনো সংস্থার জব্দ করা গাড়ি ফেলে রাখলে রাতের আঁধারে ইঞ্জিন, চাকা কিংবা পার্টস গায়েব হওয়ার নজির পুরনো। ডাম্পিং কর্মকর্তারা বলেন, নিরাপত্তায় নিয়োজিত জনবলের অভাবে তারা খোলা আকাশের নিচে থাকা এসব গাড়ির সুরক্ষা দিতে পারেন না। কিন্তু সর্বোচ্চ নিরাপত্তা প্রদানকারী ২১টি সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রপ্তানি কার্গো ভিলেজের পেছনের রানওয়ে অ্যাপ্রোন এলাকায় ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজের (বিমান) ইঞ্জিন গায়েব হয়ে গেছে। পড়ে আছে উড়োজাহাজটির কঙ্কাল।

বেসরকারি এয়ারলাইন্স কোম্পানির পরিত্যক্ত এ উড়োজাহাজের ইঞ্জিন চুরি হয়েছে নাকি ভিন্ন কোনো উদ্দেশে কেউ খুলে নিয়েছে, তাও জানে না বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। গায়েব হওয়া ইঞ্জিনটির দাম আনুমানিক ১০ কোটি টাকা বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

শাহজালাল বিমানবন্দরের রপ্তানি কার্গো ভিলেজসহ সংশ্লিষ্ট শাখা বা যাতায়াতের পয়েন্টগুলোয় সংরক্ষিত ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার (সিভিটিভি) ফুটেজ বিশ্লেষণসহ নানাভাবে অনুসন্ধান করেও গায়েব হওয়া ইঞ্জিনের হদিস পাওয়া পায়নি। প্রায় পাঁচ বছর ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ রাখার পর যে মুহূর্তে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ আকাশে ওড়ার চেষ্টা করছে, তখন স্পর্শকাতর বা সংরক্ষিত এলাকা থেকে ইঞ্জিন উধাওয়ের ঘটনায় তোলপাড় চলছে বিমানবন্দরে। বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ  (বেবিচক) কেউ এর দায় নিতে চাচ্ছে না।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এএইচএম তৌহিদ-উল আহসান গত ১২ আগস্ট বেবিচক চেয়ারম্যান বরাবর একটি চিঠি পাঠান। তাতে বলা হয়, সিভিল এভিয়েশন সিকিউরিটি প্রোগ্রাম-২০১৮ অনুযায়ী বিমানবন্দরে অবস্থানরত উড়োজাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব নিজ নিজ এয়ারলাইন্সের ওপর বর্তায়। কাজেই উড়োজাহাজের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের এখতিয়ারভুক্ত নয়।

চিঠিতে আরও বলা হয়, সরেজমিন দেখা গেছে- বর্তমানে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ লিমিটেডের ড্যাস-৮ (এস২-এইএস) উড়োজাহাজের বর্ণিত ইঞ্জিন (মডেল নম্বর এসি ০০৩৫) উড়োজাহাজের সঙ্গে সংযুক্ত নয়। ইঞ্জিনটির বর্তমান অবস্থান কোথায় এ বিষয়ে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ লিমিটেড কর্তৃপক্ষ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। রপ্তানি কার্গো অ্যাপ্রোন এরিয়ায় দীর্ঘদিন অবস্থানরত অচল উড়োজাহাজগুলোর বাজেয়াপ্ত/নিলাম কার্যক্রম আজ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এএইচএম তৌহিদ-উল আহসান আমাদের সময়কে বলেন, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের ওই উড়োজাহাজে ইঞ্জিন আছে কী নেই বা তারা ইঞ্জিন কী করেছে তা আমরা জানি না। এমনকি তারা আমাদের জানায়নি। তিনি আরও বলেন, আনঅফিসিয়ালি ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ বলেছে- তারা ইঞ্জিন খুলে সরিয়ে নিয়েছে। আবার মামলাও করেছে। তবে ইঞ্জিন আছে কী নেই এটি তাদের দেখার দায়িত্ব।

বেবিচক সূত্র বলছে, অব্যাহত লোকসানে বেবিচকের কাছে দেনা ও ব্যাংক ঋণের কারণে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফ্লাইট অপারেশন বন্ধ বা ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেওয়ার পর আটটি উড়োজাহাজ রপ্তানি কার্গো এলাকার রানওয়েতে পড়ে আছে। এর পর ওই ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানি কার্যত উড়োজাহাজ রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত বা ইঞ্জিন চালু রাখা বা নিরাপত্তা প্রদানের চেষ্টা করেনি। যদিও সিভিল এভিয়েশন সিকিউরিটি প্রোগ্রাম-২০১৮ অনুযায়ী প্রতিটি উড়োজাহাজ সংরক্ষণ, বার্ষিক অডিট বা নিরাপত্তার কথা কোম্পানির।

যোগাযোগ করা হলে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের নতুন পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ওয়াহিদুল আলম এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেবিচকের এক কর্মকর্তা জানান, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের দেনার পরিমাণ প্রায় ৯০০ কোটি টাকা। ব্যাংকঋণ ছাড়া এর মধ্যে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংসহ বিভিন্ন চার্জ বাবদ বেবিচক পাবে ২০৩ কোটি টাকা।

পরিত্যক্ত উড়োজাহাজগুলোর কারণে কার্গো ভিলেজ অংশটি অনেকটা ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে, যা অনেকখানি জায়গা দখল করে রেখেছে। পাশাপাশি এর কারণে বিমানবন্দরের মূল পার্কিং জোনে মালামাল ওঠানামার কাজে বিঘœ ঘটছে। দুই থেকে আট বছর ধরে পড়ে থাকা চারটি বেসরকারি সংস্থার ১২টি উড়োজাহাজ বাজেয়াপ্ত এবং বিক্রির জন্য নিলাম প্রক্রিয়া ঠিক করতে এরই মধ্যে বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এএইচএম তৌহিদ-উল আহসানকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করে বেবিচক। কমিটির প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে চলতি বছর আটটি উড়োজাহাজ নিলামে তোলার আলোচনা শুরু হয়।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের কার্যক্রম পুনরায় চালু করার উদ্যোগ নেয়। এর অংশ হিসেবে সংস্থাটির পুরনো পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে বিমান বিশেষজ্ঞ ও সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন বাংলাদেশ মনিটরের সম্পাদক কাজী ওয়াহিদুল আলমকে চেয়ারম্যান করে নতুন পর্ষদ গঠন করে। এতে ইউনাইটেড এয়ারের আগের পরিচালনা পর্ষদের প্রধান তাসবিরুল আলম চৌধুরী বাদ পড়েন। সংস্থাটি ২০১০ সাল থেকে বিএসইসির তালিকাভুক্ত, যা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রথম কোনো বেসরকারি বিমান সংস্থা।

নতুন পর্ষদ পুনর্গঠনের পর ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ নিলামে উদ্বেগ জানিয়ে তা বন্ধের চেষ্টা করে। পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান কাজী ওয়াহিদুল আলম ১৪ জুলাই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কাছে লেখা এক চিঠিতে দুপক্ষের আলোচনার ভিত্তিতে একটা ‘গ্রহণযোগ্য’ সমাধানে আসার ব্যাপারে অনুরোধ জানান। শাহজালাল বিমানবন্দর ছাড়াও ভারতের রাজপুর বিমানবন্দরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা তাদের একটিসহ মোট ৯টি উড়োজাহাজ মেরামতের পর আকাশে ওড়াতে চায় নতুন পরিচালনা পর্ষদ। তারা মনে করছে, উড়োজাহাজগুলোর ৫০ শতাংশ যন্ত্রাংশ এখনো ভালো আছে।

ইউনাউটেড এয়ারের অনুরোধে গত ১১ আগস্ট সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ একটি বিশেষ সভা আহ্বান করে। এতে সিদ্ধান্ত হয়, বেসরকারি এ এয়ারলাইন্স কোম্পানি নতুন করে ফ্লাইট অপারেশন করতে গেলে তাদের বকেয়া, ব্যাংকঋণ পরিশোধের পাশাপাশি নতুন করে নিবন্ধন করতে হবে।

বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ইউনাইটেড এয়ারের নতুন পরিচালনা পর্ষদ বকেয়া পরিশোধের পর ফ্লাইট অপারেশনে আগ্রহী। আমরাও চাচ্ছি দেশি মালিকানাধীন ফ্লাইট অপারেশন করুক। এখন তাদের দেনা পরিশোধ করে আমাদের কাছে নতুন করে নিবন্ধনের আবেদন করলে সেই সুযোগ হতে পারে।

Comment here