ভাড়ার চাপে এলোমেলো জীবনের স্টিয়ারিং - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

ভাড়ার চাপে এলোমেলো জীবনের স্টিয়ারিং

নিজস্ব প্রতিবেদক : দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের ত্রাহি অবস্থা। প্রায় প্রতিদিনই লাফিয়ে বাড়ছে পণ্যমূল্য। ইতোমধ্যে সারা দেশে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এর ওপর বাসগুলোতে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া দিতে হচ্ছে যাত্রীদের। বিশেষ করে রাজধানীতে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। সর্বশেষ ভাড়া বেড়েছে লঞ্চের। কয়েকগুণ ভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে পণ্যবাহী ট্রাকের। এর সঙ্গে নতুন সমস্যা যুক্ত হয়েছে বাড়তি বাড়ি ভাড়া। কয়েক মাস ধরেই নানা অজুহাতে বাড়ি ভাড়া বাড়াচ্ছেন বাড়িওয়ালারা। ফলে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের উপার্জিত অর্থের বড় একটি অংশ বাড়ি ভাড়া বাবদ ব্যয় হচ্ছে; কিন্তু তাদের আয় বাড়ছে না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে জীবনযাত্রার মানে। চাহিদা কমাতে কমাতে চিঁড়ে চ্যাপ্টা অবস্থা মানুষের। গত কয়েকদিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলে ভাড়া বৃদ্ধির তথ্য জানা গেছে। বাড়িওয়ালাদের পক্ষ থেকে বাসাভেদে সর্বনিম্ন এক হাজার টাকা বাড়ানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় সামনের দিনগুলোয় চলা আরও কঠিন হবে বলে জানিয়ে ভাড়াটিয়ারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বাড়িওয়ালাদের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের খরচ বেশি। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যেরও দাম বেড়েছে অনেক। এ ছাড়া বাড়ি দেখাশোনা ও বিভিন্ন ছোটখাটো মেরামতের কাজে খরচ বেশি হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বাসা ভাড়া বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই বলে তারা দাবি করছেন। রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের বাটা সিগন্যাল এলাকায় ভাড়া থাকেন বেসরকারি চাকরিজীবী শাহিন আহম্মেদ। নয় মাস ধরে তিনি দুই রুমের বাসা ভাড়া দিয়ে আসছেন ১৭ হাজার টাকা। তবে গত মাসে মালিক আরও এক হাজার টাকা বেশি ভাড়া দেওয়ার নোটিশ দিয়েছেন। শাহিন আহম্মেদ
বলেন, ‘চিলোকাঠায় থাকি। ফ্ল্যাটটি অতটা গোছানো নয়। তবু নানা সুবিধার কথা বিবেচনার করে থাকতে হয়। এর পরও বাসা ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ দিয়েছেন বাড়িওয়ালা। অনুরোধ করেছিলাম বাড়িওয়ালার কাছে। কিন্তু বাড়তি ভাড়া কমাতে পারবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন।’
কেবল শাহিন আহম্মেদই নন, অনেক ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবদকের। তারা বলছেন, বাড়িওয়ালারা মাঝেমধ্যেই ভাড়া বাড়িয়ে নেন। তবে এবার দ্রব্যমূল্যসহ সবকিছুর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় জীবন চালানো কষ্টকর। এর মধ্যে নতুন করে বাসা ভাড়া বাড়লে যাওয়ার জায়গা থাকবে না। এক টাকাও বেতন বাড়েনি গত তিন বছরে, কিন্তু বাসা ভাড়া বেড়েছে দুবার।
মিরপুরের শেওড়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা রাফিন আহম্মেদ। তিনি বলেন, ‘গত তিন বছরে বেতন বাড়েনি। উল্টো করোনার সময়ে বেতন অর্ধেক ছিল। কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে হু হু করে। সর্বশেষ আবারও বাসা ভাড়া বৃদ্ধির নোটিশ এসেছে। আমরা যারা নির্দিষ্ট বেতনে চাকরি করি, বাড়তি আয় নেই, তারা কোথায় যাব?’
তবে আজিমপুরের বাড়িওয়ালা শাহেনশাহ মোহাম্মদ বলেন, ‘আমরা মানুষের কষ্ট বুঝি। কিন্তু সবকিছুর দাম বেড়েছে। গ্যাস ও পানির দাম বেড়েছে। টুকটাক মেরামতের প্রয়োজন হয়। সব সময়ই রঙ করতে হয় বাড়ি। এসব খরচ বেড়েছে। তাই আমরাও সামান্য বাসা ভাড়া বাড়িয়েছি।’
দেশে সম্প্রতি জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে দূরপাল্লার পথে বাস ভাড়া বেড়েছে ২২ শতাংশ। নগরে বাস ভাড়া বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ। এর মধ্যে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগও রয়েছে। রাজধানীর সায়েদাবাদের বাস কাউন্টারগুলো ঘুরে দেখা গেছে, একেক কাউন্টারে টিকিটের দাম একেক রকম। প্রতি টিকিটে ২শ টাকা পর্যন্ত বেশি নেওয়া হচ্ছে।
রাজধানীতেও ভাড়া আদায়ে কোনো নিয়ম মানা হয় না। সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও বেশি আদায় করা হচ্ছে। কুড়িল থেকে নীলক্ষেত পর্যন্ত দূরত্ব ১৬ কিলোমিটার। নতুন হার অনুযায়ী এ দূরত্বের ভাড়া নির্ধারিত হয়েছে ৪০ টাকা। এ পথে চলাচলকারী স্মার্ট উইনার পরিবহনে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে জনপ্রতি ৫০ টাকা করে। যাত্রীপ্রতি সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে ১০ টাকা করে বেশি নেওয়া হচ্ছে। মৌমিতা পরিবহনের বাসে সাভার থেকে আজিমপুর পর্যন্ত ভাড়া আগে ছিল ৫০ টাকা। এ পথের দূরত্ব ২৩ কিলোমিটার। নতুন হার অনুযায়ী ভাড়া আসে ৫৮ টাকা। গতকাল সকাল থেকে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ৬৫ টাকা। আজিমপুর থেকে গাবতলী পর্যন্ত আগে ভাড়া নেওয়া হতো ২০ টাকা, এখন নেওয়া হচ্ছে ২৫ টাকা। সব রুটেই এ অবস্থা চলছে। এতে নিয়মিত বাসে চলাচলকারী যাত্রীরা পড়ছেন বিপাকে। বাড়তি ভাড়া গুনতে হলেও আয় বাড়েনি তাদের।
নীলক্ষেত এলাকায় বইয়ের দোকানে আট হাজার টাকা বেতনে কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন আবু বকর মিয়া। কুড়িল বিশ^রোড এলাকায় বোনের সঙ্গে থাকেন। আবু বকরের বোন কুড়িলের একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। আবু বকর বলেন, আগে লোকাল বাসে ১৫-২০ টাকায় যাতায়াত করতাম। কিন্তু এখন লোকাল বলতে কিছু নেই। সিটিং নাম দিয়ে সব লোকাল চলে। ভাড়াও বেড়েছে কয়েকগুণ। প্রতিদিন ১০০ টাকা ব্যয় হচ্ছে যাতায়াতে। উপার্জনের প্রায় সব টাকাই খরচ হয়ে যাচ্ছে যাতায়াত ও খাওয়ার পেছনে।
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে লঞ্চের ভাড়া ৩০ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। ১০০ কিলোমিটারের কম দূরত্বে প্রতি কিলোমিটারের লঞ্চ ভাড়া ২ টাকা ৩০ পয়সা থেকে ৭০ পয়সা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩ টাকা। আর দূরত্ব ১০০ কিলোমিটারের বেশি হলে ভাড়া ২ টাকা থেকে ৬০ পয়সা বাড়িয়ে ২ টাকা ৬০ পয়সা করা হয়েছে। দুই ক্ষেত্রেই ভাড়া বেড়েছে অন্তত ৩০ শতাংশ। এ ছাড়া নৌযানে জনপ্রতি সর্বনিম্ন ভাড়া ২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৩ টাকা করা হয়েছে।

Comment here