ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে রাতের মহাসড়ক - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে রাতের মহাসড়ক

সাজ্জাদ মাহমুদ খান : ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে রাতের মহাসড়ক। রাত যত গভীর হয়, ভয় আর আতঙ্ক ততই বাড়ে। বাস ডাকাতিতে লুটপাটের পাশাপাশি চলে যৌন নৃশংসতা। ডাকাতি ও নৃশংসতার ঘটনা গণমাধ্যমে প্রচার হলে প্রতিরোধে বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হয় পুলিশ সদর দপ্তর থেকে। তবে অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয় না। চলতি বছরের শুরুতে মহাসড়কে ডাকাতির ও ধর্ষণের ঘটনা প্রতিরোধে পুলিশেরে পক্ষ থেকে ১৮ দফা সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও বাস্তবায়ন হয়নি বললেই চলে।

এর মধ্যেই গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে টাঙ্গাইল মহাসড়কে বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনায় আতঙ্কিত করে তুলেছে বাসযাত্রীদের। পুলিশের যথাযথ পদক্ষেপের অভাব, বাসের চালক-সহযোগীদের নিয়ম না মানা এবং আইন ভেঙে রাতের মহাসড়ক থেকে যত্রতত্র যাত্রী তুলে রাতের যাত্রীদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. কামরুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, ডাকাতিসহ অপরাধ প্রতিরোধে দেশের মহাসড়ক সিসি ক্যামেরার আওতায় আনার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে গাজীপুর ও ময়মনসিংহ হাইওয়ের অনেকাংশ সিসি ক্যামেরার আওতায় এসেছে। বড় বাসগুলোতে পুশ বাটন স্থাপনের কাজ চলছে। বাসে ডাকাত উঠলে চালক সঙ্গে সঙ্গে পুশ বাটনে চাপ দিলে স্থানীয় পুলিশ তা জানতে পারবে। তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশের চেষ্টার পরও কিছু এলাকায় ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত আসামিদের ধরে আইনের আওতায় আনতে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।’

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলতি বছরের শুরুতে মহাসড়কে বা বাসে ডাকাতির ঘটনা নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তর, হাইওয়ে পুলিশ, পুলিশের ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজির কার্যালয় ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ একাধিক বৈঠক করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট কয়েক দফা বৈঠক করে ডাকাতি বন্ধে সমন্বিত অভিযানসহ ১৮ দফা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ব্যাপারে একমত হয়। তবে দীর্ঘ সময় কেটে গেলেও ডাকাতি বন্ধ ও যাত্রীদের নিরাপত্তায় সিদ্ধান্তের অধিকাংশ কার্যকর হয়নি। এর মধ্যেই গত মঙ্গলবার রাতে টাঙ্গাইল মহাসড়কে ডাকাতি ও নারী যাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা যাত্রীদের আতঙ্কিত করে তুলেছে।

এর আগে গত ১৬ জুন কুমিল্লার দাউদকান্দিতে কক্সবাজারগামী একটি মাইক্রোবাস ও পিকআপ ভ্যানে ডাকাতির সময় তিন যাত্রীকে কুপিয়ে আহত করে ডাকাতদল। গত ৩১ মার্চ স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং ভাগ্নিকে নিয়ে ঢাকা থেকে গাড়ি চালিয়ে কক্সবাজার যাওয়ার পথে ওই এলাকায় ডাকাতের কবলে পড়েন গাজীপুরের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ মাহবুব আলম। গত ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাতে কালিয়াকৈর যাওয়ার পথে পাকুল্লা বাজারের কাছাকাছি যাত্রীবেশে ওঠা ডাকাতদল প্রায় তিন ঘণ্টা হাইওয়ে বাস নিয়ে ঘোরাঘুরি করে টাকা ও মালামাল ছিনিয়ে নেয়। বাসের মধ্যে থাকা নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়।

যাত্রীবেশে বাসে উঠে ডাকাতির সময় ধর্ষণের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়া ডাকাতরা। এর মধ্যে ঢাকার আশুলিয়ায় হানিফ পরিবহন ও গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে স্টার লাইন পরিবহনের বাসে ডাকাতির ঘটনায় আন্তঃজেলা ডাকাতচক্রের ১০ সদস্যকে গত ১১ জুন গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। আন্তঃজেলা এ ডাকাত দল যাত্রীবেশে গত দেড় বছরে মহাসড়কে ১৫টির বেশি ডাকাতি করেছে। ঢাকা-দিনাজপুরগামী একটি বাসে ডাকাতির সময় ধর্ষণের ঘটনাও ঘটায় তারা। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া একাধিক ডাকাত ধর্ষণের কথাও স্বীকার করেছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা মহানগরের আশপাশের মহাসড়কে বিশেষ করে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক, ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বিভিন্ন এলাকা রাতে অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন পয়েন্টে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকার কারণে ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। জেলা পুলিশের সঙ্গে হাইওয়ে পুলিশের সমন্বয়হীনতার কারণেও এ ধরনের ডাকাতি বাড়ছে বলে অনেকে মনে করেন।

বাসচালক ও ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের আব্দুল্লাহপুর-টঙ্গী থেকে গাজীপুর চৌরাস্তায় প্রায়ই ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ৬-৭টি ডাকাত গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এ মহাসড়কের চান্দিনা, ভবেরচর ও সোনারগাঁ অংশে এবং ফেনীর লালপুর থেকে চট্টগ্রামের সীতাকু-ের কুমিরা পর্যন্ত বিভিন্ন পয়েন্টে বেশিরভাগ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ভৈরবের কালিকাপ্রাসাদ থেকে কুলিয়ারচরের নোয়াগাঁও ছয়সূতি, দারিয়াকান্দি থেকে বাজরার মাঝামাঝি এলাকায় মালবাহী ট্রাক-কাভার্ডভ্যানে বেশি ডাকাতির ঘটনা ঘটে। একই সঙ্গে ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা সিলেটসহ অন্যসব অঞ্চলের মহাসড়কেও ডাকাতি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেছেন, যে কোনো ডাকাতির ঘটনাকে পুলিশ অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখে। যদিও ঘটনাটি টাঙ্গাইলের, টাঙ্গাইল পুলিশের পাশাপাশি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশও ডাকাতদের গ্রেপ্তারে কাজ করছে।

বাসে ‘প্যানিক বাটন’ লাগানো নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মহানগর পুলিশ প্রধান বলেন, বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের মতো ঘটনা রোধে এই বাটন বসানোর কথা থাকলেও সব বাসে এখনো তা সম্ভব হয়নি। ঢাকার কিছু কিছু বাসে প্যানিক বাটন বসানো হয়েছে। এর পেছনে যে খরচ, তা বহনে বাস মালিকরা রাজি না হওয়ায় সব বাসে বসানো সম্ভব হয়নি।

পুলিশ জানিয়েছে, সাধারণত রাস্তা থেকে যাত্রীবেশে ডাকাতদল বাসে ওঠে। এ ছাড়া রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে গাড়ি আটকে ডাকাতি, প্রাইভেট কারে তুলে জিম্মি করে ডাকাতি, মহাসড়কে চলন্ত গাড়ির সামনের গ্লাসে ইট পাথর মেরে থামিয়ে গাড়ি আটকিয়ে ডাকাতি করে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছরের শুরুতে ডাকাতি বন্ধে সমন্বিত অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। স্থানীয় থানা পুলিশের পাশাপাশি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করেও ডাকাত সদস্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। ডাকাতি বন্ধে তারা প্রতিটি বাসে পুস বাটন নামে একটি ইলেকট্রিক ডিভাইস লাগানোর পরিকল্পনা করছেন। যাতে বাসে ডাকাত সদস্যরা হানা দিলে ওই বাসটিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সহজেই শনাক্ত করতে পারে। একই সঙ্গে বাসগুলোতে জিপিএস লাগানো, আইপি ক্যামেরা বসিয়ে মনিটরিং করা, হাইওয়ে পুলিশের প্যাট্রোলিং বাড়ানো, দূরপাল্লার বাস ছাড়ার আগে যাত্রীদের ভিডিও করে রাখার কার্যক্রম জোরদার, যাত্রীদের এনআইডি ও মোবাইল নাম্বার সংরক্ষণ করা, ডাকাতদের একটি সমন্বিত ডাটাবেস তৈরি করা ও বাসের রুট পারমিট চেক করার সিদ্ধান্ত হয়। তবে এসব সিদ্ধান্তের অধিকাংশই এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহাদত হোসেন সোমা বলেন, ডাকাতির মামলায় আসামিদের গুরুত্ব দিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে আসামিরা জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়ছে। কয়েক মাস আগে গ্রেপ্তার হওয়া আসামিরাও জামিনে ছাড়া পেয়েছে। ডাকাতি বন্ধে একটা সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান এ পুলিশ কর্মকর্তা।

হাইওয়ে পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, হাইওয়ের দৈর্ঘ্য অনুযায়ী আমাদের লজিস্টিক সাপোর্ট ও জনবল কম। হাইওয়েতে গাড়ি চলে ১০০ কিমি বেগে। আমাদের গাড়ি সেই গতিতে চলতে পারে না। আমরা চাই ঘটনার পাঁচ মিনিটের মধ্যে স্পটে পৌঁছতে। কিন্তু লজিস্টিক সাপোর্টের কারণে সেটা সম্ভব হয় না অনেক সময়। তবে আমরা আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ চেষ্টা করে থাকি।

 

Comment here