জনি রায়হান : মিরপুর রূপনগরের ১১ নম্বর সড়কে বেলুনের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মাত্র তিন দিন আগেই মারা গেছে নিস্পাপ ৭ শিশু। এখনো হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন অনেকেই। একটি বেলুনের গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের এমন ভয়াবহতা দেখে বিস্মিত দেশবাসী। নিহত ও হতাহতের সবাই ছিল ওই সড়কসংলগ্ন একটি বস্তির বাসিন্দা।
এই ঘটনার পরে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে গোটা বস্তিবাসী। তবে তারচেয়েও ভয়ানক বিষয় হলো পুরো বস্তিতে ছড়ানো আছে শত শত অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইন। কোথাও টেপ দিয়ে পেঁচিয়ে চুলার সঙ্গে চোরাই গ্যাস লাইনের সংযোগ দেওয়া হয়েছে। আবার কোথাও চিকন পাইপে গ্যাসের লাইন হালকা চাবি দিয়ে জোড়া লাগানো হয়েছে। ঘরের মেঝেতে এবং দেওয়ালের গায়ে ঝুলছে বিদ্যুতের চিকন চিকন তার। বিদ্যুতের মূল সংযোগের ক্যাবল কেটে কোনোমতে চুরি করে পুরো বস্তিজুড়ে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ। যেগুলোর নেই কোনো সঠিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
পুরো বস্তির এমন চিত্র দেখে মনে হবে এই বস্তি যেন এক অবিস্ফোরিত বোমা। যেকোনো সময় গ্যাসের বা বিদ্যুতের এসব অরক্ষিত লাইনগুলো থেকে আগুন লেগে যেতে পারে বস্তির ঘরে।
আর এতে নারী শিশুসহ হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুর মুখে পতিত হতে পারে। অথচ গ্যাস-বিদুতের এসব চোরাই লাইনের কথা স্বীকারও করছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষরা। সব জেনে-শুনেও নামমাত্র অভিযানের দোহাই দিয়েই চুপ রয়েছেন তারা। আর এতে সরকারের লাখ লাখ টাকার গ্যাস, বিদুৎ লুট হচ্ছে প্রতিদিনই। লাখ লাখ টাকার গ্যাস-বিদ্যুৎ চুরি করে সাপ্লাই দেওয়া হচ্ছে ওই বস্তিতে।
স্থানীয়রা বলছেন, ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙিয়ে কয়েকজন ব্যক্তি সরকারি খাল দখল করে; সংশ্লিষ্ট বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে এই কাজ চালাচ্ছেন।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও বার বার নোটিশ দিয়ে এর কোনো প্রতিকার পাননি বলে অভিযোগ করেছেন।
দৈনিক আমাদের সময় অনলাইনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, মজিবর, মিন্টু, লতিফের স্ত্রী মিম, রুমা, রোজি খালা, নিলুফা, কামরুলসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী দীর্ঘ দিন থেকে ওই বস্তিতে ঘর তৈরি করে সেখানে অবৈধ গ্যাস- বিদ্যুতের সংযোগ এনে ঘর ভাড়া দিয়ে যাচ্ছেন।
তবে তাদের চেয়েও ক্ষমতাশালী হলেন, হাজী রমজান আলী মাতবর ও ফয়জুল আলী মাতবর নামে দুই ভাই। তাদের নামানুসারে কেউ কেউ ওই বস্তিকে মাতবরের বস্তি বলেও ডাকেন।
কী নাম এই বস্তির?
রূপনগরের এই বস্তিটির পূর্ণাঙ্গ কোনো নাম নেই। কেউ কেউ এই বস্তিটিকে বলে শিয়ালবাড়ী বস্তি, কেউ বলে ঝিলপাড় বস্তি, কেউ বলে মাতবরের বস্তি। আবার কেউ বলে টংঘর বস্তি। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রায় ৩৫ একর জায়গাজুড়ে এই বস্তিটি বিস্তৃত।
পুরো বস্তি যেন এক ‘মৃত্যুকূপ’
সরেজমিনে ওই বস্তিতে গিয়ে দেখা যায়, জলাশয়ের পানির উপরে বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে টং। এসব টংয়ের ওপরে আবার তক্তা বিছিয়ে তার ওপরে বানানো হয়েছে টিনের ঘর। আর পুরো বস্তিতে চলাচলের জন্য বাঁশ দিয়েই পানির ওপর বানানো হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা। এসব বাঁশ ও তক্তার পাশ দিয়ে টাঙানো, পেঁচানো রয়েছে গ্যাস-সংযোগ এবং বিদ্যুতের লাইন। এক ঘর থেকে অপর ঘরে ছোট ছোট তার জোড়া লাগিয়ে বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া হয়েছে।
বস্তিতে ঢোকার পর একটু এগিয়ে গিয়ে প্রথমেই চোখে পড়লো একটি ছোট ঘরে এক নারী রান্না করছেন। সেই ঘরে গিয়ে দেখা গেল, পাশাপাশি তিনটি গ্যাসের চুলা বসানো। একটি চুলায় রান্না চলছে, অপর চুলাটি বন্ধ করা। তিনটে চুলাই একটি চিকন পাইপ দিয়ে টানা গ্যাসের লাইনের সঙ্গে স্কচটেপ দিয়ে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। ঘরের মধ্যে ঝুলানো আছে বিদ্যুতের তারও। সরু অলি-গলিতে ছুটে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট শিশুরা। যে কোনো সময় বিদ্যুতের তারের লিকেজের কারণে ঘটতে পারে প্রাণহানী।
কত টাকায় ঘর ভাড়া হয় বস্তিতে
ওই বস্তিতে থাকা কমপক্ষে ৫০ জন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ২ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত মাসিক ভাড়ার ঘর পাওয়া যায় সেখানে।
বস্তির বাসিন্দা মো. নজরুল ইসলাম দৈনিক আমাদের সময় অনলাইনকে বলেন, ‘আমি চার বছর ধরে এই বস্তিতে থাকি। রাজমিস্ত্রীর কাজ করে সংসার চালাই। আমাদের আশেপাশের ঘরগুলোর ভাড়া ২৫০০ টাকা করে। অন্য ঘর আবার ৩০০০ টাকাও আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই ২৫০০ টাকার মধ্যেই গ্যাস,পানি,বিদ্যুৎ সব কিছুই।’
এসব অবৈধ গ্যাস বিদ্যুতের বিল আদায় কে করে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা তো আমরা জানি না। আমরা ঘর মালিককে টাকা দেই। এরপর তারা কই দেয়, সেটা জানি না।’
আগেও আগুন লেগেছিল ওই বস্তিতে
বিগত দেড় যুগে অনেকবার ওই বস্তিতে আগুন লেগেছিল বলে জানিয়েছে একাধিক পুরাতন ভাড়াটে ও স্থানীয়রা। কখনো ছোট বা কখনো বড় আগুনের ঘটনায়ও শিক্ষা নেয়নি তারা।
তবে ঘরমালিক ও বস্তিবাসীর দাবি, চলনন্তিকা বস্তির ভয়াবহ আগুনের ঘটনার পরে অনেকটাই সাবধান হয়েছেন তারা।
মো. সোহেল মিয়া নামে বস্তিবাসী এক যুবক বলেন, ‘আমি ২০০০ সাল থেকে এই বস্তিতে থাকি। আগে ঘর ভাড়া ছিলো ৬০০/৭০০ টাকা এখন ৩০০০ টাকা হইছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি নিজেই অনেকবার আগুন লাগার ঘটনা দেখেছি। চলন্তিকা বস্তির আগুনের দৃশ্য দেখে আমিও বস্তি ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু অন্য বাসার ভাড়া বেশি তাই ঘুরে ফিরে আবারও বস্তিতে এসেছি।’’
মিরপুর ৭ নম্বর চলন্তিকা মোড়ের ঝিলপাড় বস্তিতে ১৬ আগস্ট রাতে ভয়াবহ আগুনে ঘটনা ঘটেছিল। ওই আগুনে শত শত ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। প্রায় তিন হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সেই ঘটনায়।
অবৈধ গ্যাস-বিদ্যুতের অদ্ভুত ব্যাখ্যা দিলেন ঘর মালিকরা
ওই বস্তিতে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ঘর ভাড়া দিয়ে আসছিলেন লতিফ নামে এক প্রভাবশালী ব্যক্তি। কিছু দিন তিনি মারা গেছেন। এরপর থেকে ঘরগুলো দেখাশোনা করেন লতিফের স্ত্রী রোজী বেগম।
রোজী দৈনিক আমাদের সময় অনলাইনকে বলেন, ‘বস্তিতে আমার ২০টা ঘর আছে। পানি বিদ্যুৎ, গ্যাসে সব কিছু মিলে ২৫০০ টাকা করে ঘর ভাড়া নেই।’
গ্যাস এবং বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ কীভাবে নিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি দৈনিক আমাদের সময় অনলাইনকে বলেন, ‘এক লোক আইসা লাইন দিয়ে গেছে। তারে আমি চিনি না। তার নাম বা পরিচয় আমি কিছুই জানি না। সে শুধুমাত্র মাসে মাসে আইসা ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা কইরা নিয়া যায়।’
শিয়ালবাড়ীর ওই বস্তির অপর এক ঘর মালিক রুমা খাতুন। ওই বস্তিতে তারও ৩০টির বেশি ঘর আছে বলে জানা গেছে।
তিনি দৈনিক আমাদের সময় অনলাইনকে প্রথমে বলেন, ‘আমার কোনো ঘর নাই বস্তিতে। আমার দেবর-ননাসদের ঘর আছে। তারা দুলালের মাধ্যমে ৭ নম্বর ব্লক থেকে গ্যাসের পাস করাইয়া আনছে।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে নিজেরও ঘর থাকার কথা স্বীকার করে রুমা বলেন, ‘আমরা চুলায় রাইজার লাইগাইয়া দিছি, আগুন লাগার কোনো সুযোগ নাই। দুপুরে আর সকালে আমরা চাবি দিয়ে রাখি। কারণ কিছু দিন আগে আমরা চলন্তিকা বস্তিতে দেখে শিক্ষা নিছি। এভাবে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভবনা নাই।’
ওই বস্তির সবচেয়ে বেশি ঘরের মালিক
হাজী রমজান আলী মাতবর ও তার ভাই ফয়জুল আলী মাতবরের সঙ্গে একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা কেউই ফোন রিসিভ করেননি।
অভিযানের দোহাই দিয়ে চুপচাপ কর্তৃপক্ষ
রুপনগরের ওই বস্তির চোরাই বিদ্যুতের বিষয়টি স্বীকার করে ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) রূপনগর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সুলতান দৈনিক আমাদের সময় অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা ওই বস্তিতে প্রায়ই অভিযান চালিয়ে অবৈধ বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেই। এরপরেও তারা চোরাইভাবে লাইন টেনে নেয়। গত সপ্তাহেও আমরা কয়েকবার সেখানে অভিযান চালিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বিষয়টি সেখানকার স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ কাউন্সিলরকেও জানিয়েছি সহায়তার জন্য। আমরা এটাও বলেছি আপনারা খুঁটির মাধ্যমে বৈধভাবে বিদ্যুৎ নেন। আমরা বৈধভাবে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে দেব।’
তিতাস গ্যাসের মিরপুর-১২ জোনের দায়িত্বরত কর্মকর্তা ইঞ্জিনিয়ার মনিরুল ইসলাম দৈনিক আমাদের সময় অনলাইনকে বলেন, ‘আমি দায়িত্বে আসার পরে এমন কয়েকটি বস্তিতে গত তিন মাসে একাধিক অভিযান পরিচালনা করেছি। অভিযানের সময় শত শত অবৈধ গ্যাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। কিছু দিন আগে ওই বস্তির এক পাশে আগুন লাগার ঘটনাও ঘটেছিল বলে শুনেছি। আমরা নিয়মিত আমাদের অভিযান চালিয়ে এসব অবৈধ সংযোগগুলো বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছি।’
‘সরকারি জলাশয় দখল করা হয়েছে,সবই অবৈধ’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরশনের ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মোবাশ্বের চৌধুরী দৈনিক আমাদের সময় অনলাইনকে বলেন, ‘সেখানে টোটালি অবৈধভাবে এসব সংযোগ দেওয়া আছে। গ্যাস বেলুন থেকে যে ঘটনাটি ঘটেছে তার থেকেও চলন্তিকা বস্তির মতো বড় ভয়াবহ ঘটনা তো এখানে ঘটতে পারে। এখানে আগুন লেগে যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সেখানে ঘর তুলে দীর্ঘ দিন যাবত তারা অবৈধভাবে এসব ব্যবসা করে যাচ্ছে। আমরা বিষয়টি তিতাস এবং বিদ্যুৎ অফিসকেও একাধিকবার জানিয়েছি। কিন্তু তারা তেমন কোনো পদক্ষেপ নেন না। তারা শুধুমাত্র দায়সারা ভাব সারতে চায়। তারা যদি চায় তাহলে অবশ্যই গ্যাস-বিদ্যুত চুরি করে লাইন নেওয়া বন্ধ হবে। একেকজনের ১০০ থেকে ১৫০টি করে ঘর ভাড়া দিয়ে খায়।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা মূলত গৃহহায়ন ও গণপূর্তের জায়গা। এটি একটি জলাশয়। এটা কেউ দখল করে রাখতে পারবে না। এটাকে দখল মুক্ত করে মিনি হাতিরঝিলের মতো একটি প্রোজেক্ট করার পরিকল্পনা আছে আমাদের।
Comment here