রেলে আয়ের ‘সহজ বুদ্ধি’ ভাড়া বৃদ্ধি - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

রেলে আয়ের ‘সহজ বুদ্ধি’ ভাড়া বৃদ্ধি

তাওহীদুল ইসলাম : রেলে আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি। আয় কত তার হিসাব দিতে পারলেও ব্যয়ের কোনো হিসাব মেলাতে পারছে না বাংলাদেশ রেলওয়ে। কী কী ব্যয়ের খাত হিসাবে দেখা দেবে তাও বলতে পারছে না সংস্থাটি। তাই সংসদীয় কমিটি জানতে চাইলেও তারা কোনো জবাব প্রস্তুত করতে পারেনি রেল কর্তৃপক্ষ। তবে আয় বাড়াতে ভাড়া বৃদ্ধি করতে হবে এমন পথ বাতলে দিয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার রেলপথ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এসব উত্থাপনের কথা রয়েছে।

গত জুনে রেলপথ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি আয় বৃদ্ধির পথ খুঁজতে বলে। ঘাটতি কমানোর কর্মপরিকল্পনায় রেলের কমিটি ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। উৎসবের সময়, যখন টিকিটের চাহিদা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে তখন বিমানের মতো ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধি এবং ভারতীয় রেলের মতো ‘তৎকাল’ পদ্ধতি চালুরও প্রস্তাব করা হয়েছে।

লোকসান কমাতে রেলওয়ে অনেক দিন ধরেই ভাড়া বাড়ানোর চেষ্টা করছে। ২৫ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধির খসড়া প্রস্তাব তৈরি করেছে ২০২০ সালের আগস্টে। রুট ভেদে ৪৩ থেকে ৮০ শতাংশ

পর্যন্ত ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব রয়েছে খসড়ায়। এ বছরের ট্রেনের প্রথম শ্রেণির ভাড়ায় ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করেছে সরকার। রেলের উন্নয়ন প্রকল্পের ঋণদাতারা লোকসান কমাতে বলছে। ঋণদাতা এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকও (এডিবি) লোকসান কমাতে ভাড়া বাড়াতে বলেছে। ভাড়া বৃদ্ধি ছাড়াও অনেক পথ আছে আয় বাড়ানোর। কিন্তু সেদিকে নজর কম রেল কর্তৃপক্ষের। তবে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার শাহাদাত আলী আমাদের সময়কে বলেন, ট্রেনের আয় বাড়ানোর জন্য অনেকগুলো পরিকল্পনা আছে। এর একটি হচ্ছে ভাড়া বৃদ্ধি।

গত ৫ জুন অনুষ্ঠিত সংসদীয় কমিটির ২০তম সভায় প্রতিদিন ট্রেন পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের সঠিক আয়-ব্যয়ের হিসাব এবং ঘাটতি থেকে বের হওয়ার সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়। সুপারিশ অনুযায়ী, কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের পৃথক কমিটি করা হয়।

পশ্চিমাঞ্চলের কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট ( (সিওপিএস) মোঃ শহিদুল ইসলাম। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন- প্রধান বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক (সিসিএম) মোহাম্মদ আহছান উল্যা ভূঁঞা এবং প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী (সিএমই) মুহাম্মদ কুদরত-ই-খুদা।

কর্মপরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ভাড়া বাড়িয়ে ঘাটতি পূরণ করতে হবে। সড়ক, নৌ ও বিমানপথের তুলনায় রেলের ভাড়া যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করা প্রয়োজন। ট্রেন পরিচালনার খরচ বিবেচনায় নিতে হবে। প্রয়োজনে সরকার ভর্তুকি দিতে পারে।

আয় বাড়াতে সকল প্রধান রেলপথকে ডাবল লাইনে উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ঢাকা-জয়দেবপুর সেকশন দেশের সবচেয়ে ব্যস্ত রেলপথ। এ পথে ২৫টি অনুমোদিত এবং ২০ অননুমোদিত লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এ কারণে ৩০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে ট্রেন চালানো যায় না। রেললাইন মাটির নিচে বা উড়াল হলে ৮০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালানো সময়। এতে ট্রেনের সংখ্যা বাড়বে, আয় বাড়বে।

ট্রেনে বগি বাড়ানোর মাধ্যমে আসন বৃদ্ধি করে আয় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, একটি ব্রডগেজ ট্রেন ২০টি বগি নিয়ে চলতে সক্ষম। বগি সংকটে ১২টি নিয়ে চলছে। মালবাহী ট্রেন বাড়াতে হবে। মালবাহী ট্রেন ব্যয়ে তিনগুণ আয় করে। যাত্রীবাহী ট্রেনে খরচের সমানও আয় করা যায় না। বর্তমানে চালক সংকটে প্রতিদিন ৪/৫টি পণ্যবাহী ট্রেনের যাত্রা বাতিল করতে হয়। চালক, জনবল বাড়াতে হবে।

ট্রেনেও বিমানের মতো ভাড়া পদ্ধতি চালুর প্রস্তাব রয়েছে কর্মপরিকল্পনায়। এতে বলা হয়েছে, উৎসবের সময় ধারণ ক্ষমতার বেশি যাত্রী পরিবহন করা হয় ট্রেনে। এতে বগির ব্যাপক ক্ষতি হয়। আর্থিক ক্ষতিও হয়। এক্ষেত্রে চাহিদা বাড়লে টিকিটের দাম বৃদ্ধি এবং চাহিদা কমলে ভাড়া কমবে- এ পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে। ভারতীয় রেলে ‘তৎকাল’ পদ্ধতিতে কিছু টিকিট রিজার্ভ রাখা হয়, যা জরুরি প্রয়োজনে ভ্রমণ করা যাত্রীরা বেশি দামে কেনেন। বাংলাদেশেও একই পদ্ধতি চালু হলে আয় বাড়বে। ভারতীয় রেলের বিভিন্ন কোম্পানি ও ফার্ম রয়েছে। আয় বাড়াতে বাংলাদেশেও তাই করতে পারে।

জাপান, মালয়েশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকার মতো রেলওয়ে স্টেশনগুলোকে বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত করার মাধ্যমে আয় বৃদ্ধির প্রস্তাব রয়েছে কর্মপরিকল্পনায়। স্টেশনে ও ট্রেনে বিজ্ঞাপন প্রচার করে জাপান রেল আয়ের ১৭ শতাংশ উপার্জন করে। রেলের জমিতে হোটেল, শপিংমল, হাসপাতালসহ বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ করা যেতে পারে।

রেলওয়ের অপারেশন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের মে পর্যন্ত যাত্রী পরিবহন করে আয় হয়েছে ৭৩৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। পণ্য পরিবহনে আয় হয়েছে ৩২৫ কোটি ৪৯ লাখ টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪৩ এবং ২৭ শতাংশ কম। জমি ভাড়া খাটিয়ে আয় বৃদ্ধির কথা বললেও গত অর্থবছরের মে মাস পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার জমি ইজারা দিয়ে মাত্র ৪২ কোটি ৯৭ লাখ টাকায় আয় করেছে রেল। গত অর্থবছরে রেলের পরিচালন খাতে ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা। উন্নয়ন খরচ করা হয়েছে ১২ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। ১৬ হাজার ৩৩৭ কোটি ব্যয়ের বিপরীতে গত ৩১ মে পর্যন্ত রেলের আয় এক হাজার ২৭০ কোটি টাকা। ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ঘাটতি এক অর্থবছরেই।

চলতি অর্থবছরে রেলের পরিচালনায় ৩ হাজার ৮৬৬ কোটি এবং উন্নয়নে ১৪ হাজার ৩২৮ কোটি বরাদ্দ রয়েছে। পরিচালন বরাদ্দ খরচ হয় রেল চালানো, বেতন ভাতায়। উন্নয়ন বরাদ্দ খরচ হয় নতুন রেলপথ নির্মাণ, ইঞ্জিন বগি কেনায়। রেলের এ বছরও রেলের লক্ষ্য দেড় কোটি টাকা আয় করা, যা ট্রেন চালাতে যে খরচ হবে- তার অর্ধেকও নয়। বেসরকারিভাবে ট্রেন পরিচালনা করেও লোকসান গুনছে রেল। বর্তমানে ৪০টি ট্রেনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বেসরকারিভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এরমধ্যে পূর্বাঞ্চলে ৪০টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ১৬টি। ২০২১-২২ অর্থবছরে বেসরকারিভাবে পরিচালিত ট্রেনে গড়ে মাসিক আয় ৩ কোটি ১১ লাখ ২৯ হাজার টাকা। রেলের বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য সকল স্টেশন ও অব্যবহৃত জমিতে সোলার প্যানেল স্থাপনের বিষয় নিয়েও আজকের সংসদীয় কমিটির বৈঠকে আলোচনার কথা রয়েছে।

 

Comment here