লঞ্চ ডুবে হরেদরে মানুষের মৃত্যু এ দেশে নতুন নয়। আর লঞ্চডুবির পরে সবচেয়ে অবশ্যম্ভাবী বিষয় হচ্ছে ‘তদন্ত কমিটি’। অতীতের তথ্য বলছে, এসব তদন্ত কমিটির প্রায় কোনো সুপারিশই বাস্তবায়িত হয়নি। বেশির ভাগ কমিটির তথ্যই অপ্রকাশিত থেকে গেছে। তাই শাস্তিও পান না দায়ী ব্যক্তিরা।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর হিসাব বলছে, ১৯৭৬ সাল থেকে গত ৪৪ বছরে ৭৩২টি নৌ দুর্ঘটনায় ১০ হাজারের মতো মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এসব ঘটনায় ৫৩২টি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা পড়েছে। দুর্ঘটনার তদন্তে কমিটি হলেও সুপারিশ বাস্তবায়নের বেলায় ঠনঠন।
সর্বশেষ গত সোমবার সদরঘাটে ময়ূর-২ নামের আরেকটি লঞ্চের ধাক্কায় ডুবে যায় মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে ছেড়ে আসা মর্নিং বার্ড নামের একটি ছোট লঞ্চ। ওই ঘটনায় গতকাল আরও দুজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ নিয়ে ওই দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হলো। আরও এক যাত্রী নিখোঁজ বলে জানিয়েছেন তাঁর স্বজনেরা। দুর্ঘটনার শিকার মর্নিং বার্ড লঞ্চটি উদ্ধার করা হয়েছে। লঞ্চের ভেতর লাশের সন্ধান না পাওয়ায় উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করেছে বিআইডব্লিউটিএ।
এ ঘটনায়ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাত সদস্যের কমিটি গঠিত হয়েছে। কমিটির আহ্বায়ক নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, প্রাথমিকভাবে তাঁদের মনে হয়েছে, ছোট লঞ্চ মর্নিং বার্ডকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ডুবিয়ে দিয়েছে ময়ূর-২।
এ ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। তবে গতকাল মঙ্গলবার মামলা হয়েছে ময়ূর-২ নামের লঞ্চটির মালিকসহ সাতজনের বিরুদ্ধে। গত ৪৪ বছরে ৭৩২টি নৌদুর্ঘটনায় ৫৩২টি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তবে এসব তদন্ত কমিটির সুপারিশ প্রায় বাস্তবায়িত হয়নি বললেই চলে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন সরকারি ও বেসরকারি একাধিক সংস্থা এসব তথ্য জানিয়েছে।
নিরাপদ নৌপথ বাস্তবায়ন আন্দোলনের সদস্যসচিব আমিনুর রসুল প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৪ সালের ৪ আগস্ট পদ্মায় আড়াই শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় পিনাক-৬ নামের একটি লঞ্চ। ওই ঘটনায় কারও শাস্তিই হয়নি। তাঁর অভিযোগ, লঞ্চ দুর্ঘটনায় তদন্ত কমিটির কোনো সুপারিশই বাস্তবায়িত হয়নি। মাঝেমধ্যে প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নামমাত্র জরিমানা করা হলেও দৃষ্টান্তমূলক শান্তি হয়নি।
২০১২ সালে মেঘনায় এমভি শরীয়তপুর ডুবে গেলে দেড় শতাধিক যাত্রী মারা যান। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী কারও শাস্তি হয়নি।
২০০২ সালে এমভি সালাউদ্দিন-২-এর দুর্ঘটনায় প্রায় চার শ যাত্রী নিহত হন। ওই দুর্ঘটনার অভিযুক্ত ব্যক্তির শাস্তিসংক্রান্ত ফাইল গায়েব হয়ে যায়। দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চের মালিকের শাস্তি সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
২০০৩ সালে এমভি নাসরিন দুর্ঘটনায় আট শতাধিক যাত্রীর প্রাণহানি হয়। তদন্ত কমিটি নৌপরিবহন অধিদপ্তরের অভিযুক্ত ব্যক্তিকে চাকরিচ্যুত করা এবং মালিকের লঞ্চটির নিবন্ধন বাতিলের সুপারিশ করেছিল। কিন্তু সুপারিশ মানা হয়নি।
গতকাল রাতে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওভারনাইট কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। কিন্তু নৌপরিবহন সেক্টরে অনেক সুপারিশ বাস্তবায়ন করছি। অনেক ডেভেলপ করা হচ্ছে। আনফিট লঞ্চ আস্তে আস্তে ক্লোজ করে ফেলছি। সেক্টরটি একটি সিস্টেমে আনা হবে।’
খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ আইএমওর (আন্তর্জাতিক মেরিটাইম অর্গানাইজেশন) সদস্যভুক্ত দেশ। এভাবে নৌযান দুর্ঘটনা ঘটলে সেখানেও দেশটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।
Comment here