সারাদেশ

শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তনের আভাস “গুণগত শিক্ষাই হোক মূল লক্ষ্য”

মাজহার মান্নান.
                  কবি, ছড়াকার, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট :

শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষা ছাড়া কোন জাতির পক্ষেই এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সেই শিক্ষাটি কোন ধরনের হওয়া প্রয়োজন। যে শিক্ষা গ্রহণ করে একজন যুবক সমাজ, রাষ্ট্র তথা নিজের জন্য কিছু করতে পারে না সেই শিক্ষা তার জন্য আশীর্বাদের বদলে অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়।  শিক্ষা হল তাই যা একজন মানুষকে তার নিজের অস্তিত্বের জন্য এবং সমাজের কল্যাণের জন্য দক্ষ করে তোলে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে আমাদের বর্তমান মুখস্থ নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা যুবকদের মাঝে সেই দক্ষতা সৃষ্টিতে ব্যর্থ।  সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি বলেছেন যে শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরণের পরিবর্তন আসতে চলেছে। এটি আমাদের কাছে একটি আশা জাগানিয়া খবর। শিক্ষা ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা বিশেষজ্ঞরা বার বার বলে আসছে।  শিক্ষামন্ত্রীর মুখ থেকে শিক্ষা ব্যবস্থার গুণগত মান  উন্নয়নে যে আভাস পাওয়া গেছে তা থেকে কয়েকটি বিষয় আমাদের কাছে পরিষ্কার।

    ১. পাঠ্য পুস্তকে  বড় ধরণের পরিবর্তনের ইঙ্গিত
২. গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ
৩. দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দান
৪. শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা
৫. মাধ্যমিক স্তরে বিভাগ বিভাজন তুলে দেয়া
৬. কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিস্তার করা
৭. জীবন ও কর্মমূখী শিক্ষাকে প্রাধান্য দেয়া
৮. নৈতিক শিক্ষাকে আরও গুরুত্ব দেয়া
৯. প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতির সংষ্কার করা
১০. মানসম্মত কারিকুলাম নিশ্চিত করা

শিক্ষামন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই শিক্ষাক্ষেত্রে এ ধরণের পরিবর্তন গুলি আনার জন্য দ্রুত গতিতে কাজ করে চলেছেন।  তবে শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হলে কার্যকরী কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।
১. বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। বর্তমানে যে বাজেট শিক্ষা খাতে দেয়া হয় তা মোট বাজেটের ১৫ শতাংশের নিচে। ইউনেসকো বারবার শিক্ষা খাতে মোট বাজেটের ২০ শতাংশ দেয়ার কথা বলে আসছে। বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ না বাড়ালে গুণগত শিক্ষার জিকির তুলে কোন লাভ হবে না।  ব্যানবেইস এর তথ্য মতে মাধ্যমিক স্তরে ৩০ শতাংশ শিক্ষকের কোন প্রশিক্ষণ নেই। ৩০ শতাংশ বিদ্যালয়ে কোন বিজ্ঞানাগার নেই। অবকাঠামোগত দুর্বলতাকে কাটিয়ে না উঠতে পারলে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না।
২. গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে গাইড ও নোট বইয়ের উপর শিক্ষার্থীদের নির্ভরতা কমাতে হবে। মানসম্মত পাঠ্য বই তৈরি ও শ্রেণিকক্ষে মানসম্মত পাঠদান নিশ্চিত করতে হবে।
৩. অতিরিক্ত কোচিং প্রবনতা কমাতে হবে। গাইড বই ও কোচিং নির্ভরতা শিক্ষার্থীদের সুপ্ত মেধাকে বিকশিত হতে বাধা দেয়। তাই এ দুটির লাগাম টেনে না ধরতে পারলে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না।
৪. পাঠ্য বইতে প্রশ্ন ব্যাংক তৈরি করে দিতে হবে। নির্ধারিত প্রশ্ন ব্যাংক থেকে সৃষ্টিশীল প্রশ্নের মাধ্যমে পরীক্ষা নিতে হবে।
৫. আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরীক্ষা পদ্ধতি গুণগত শিক্ষার জন্য মোটেও অনুকুল নয়। অতিরিক্ত পরীক্ষার চাপ, পরীক্ষায় জিপিএ ৫ লাভের একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা গুণগত শিক্ষা লাভের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হয়েছে দাঁড়িয়েছে।
৬. মুখস্থ নির্ভর ও সনদ নির্ভর শিক্ষার জালে আমরা এখনো আটকা পড়ে আছি। শিক্ষা জীবন শেষে শুধু একটি কাগজই হাতে আসে মাত্র। কোন ধরনের দক্ষতা তৈরি হয় না।  যার ফলে বেকারদের লম্বা সারি তৈরি হচ্ছে।
৭. দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জন্য। কেননা একটি জরিপে দেখাচ্ছে যে শতকরা ৯০ শতাংশ শিক্ষর্থী প্রাথমিক স্তর অতিক্রম করে অংকে দুর্বলতা নিয়ে। তাই যোগ্য শিক্ষক দরকার হবে। এজন্য শিক্ষকদের ভাল বেতন ও সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
৮. জীবন ও কর্মমূখী  শিক্ষা ছাড়া আমাদের এগিয়ে যাওয়ার কোন রাস্তা নেই। এজন্য কারিগরি, ভোকেশনাল, ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে হবে।
৯. শিক্ষকদের উচ্চ প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের জন্যও বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
১০. উচ্চ শিক্ষার লাগাম টেনে ধরতে হবে। সবার জন্য উচ্চ শিক্ষা প্রয়োজন নেই। উচ্চ শিক্ষা হবে সম্পূর্ণ গবেষণাধর্মী।
শিক্ষা নীতিমালা ২০১০ এ যে নির্দেশনাগুলি আছে সেগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন করতে পারলে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতে আর কোন বাধা থাকবে না। একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যদি মানসম্পন্ন হয় তাহলে সেই দেশের উন্নয়ন দ্রুত হয়। ভারত, পাকিস্থান, শৃলংকা ও নেপাল গুণগত শিক্ষার দিকে হাটছে। দক্ষ যুব সমাজ তৈরি করতে পারলে আমরা সহজেই উন্নত দেশের কাতারে যুক্ত হতে পারবো।

শিক্ষা পদ্ধতিকে ঢেলে সাজাতে হবে। বার বার সিলেবাস পরিবর্তন, পাঠ্য পুস্তক পরিবর্তন করলে  শিক্ষার্থী সেটার সাথে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হয়। তাই একটি স্থায়ী ও মানসম্মত শিক্ষাক্রম, যুগপোযোগী সিলেবাস ও পাঠ্য পুস্তক এখন সময়ের দাবি।  শিক্ষকদের ভাল বেতন না দিতে পারলে গুণগত শিক্ষার প্রত্যাশা অধরাই থেকে যাবে।

Comment here

Facebook Share