‘শুদ্ধ’ বিমান কতদূর - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
জাতীয়

‘শুদ্ধ’ বিমান কতদূর

লাগামহীন অনিয়ম-দুর্নীতির জেরে গত ৩০ এপ্রিল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোসাদ্দিক আহমেদকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। কিন্তু এর পরও বিমান থেকে সরানো যায়নি অনিয়ম-দুর্নীতির কালো ছায়া।

রাষ্ট্রায়ত্ত এ সংস্থাটির ভেতরে এখনো সক্রিয় দুর্নীতিবাজদের সিন্ডিকেট। এ তালিকায় রয়েছে পরিচালনা পর্ষদের সদস্যও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনিয়ম-দুর্নীতি দূর করে বিমানকে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার নির্দেশ দেওয়ার পর কয়েক মাস আগে বিমানে শুদ্ধি অভিযান শুরু করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। কিন্তু এ শুদ্ধি অভিযান ব্যাহত করতে নানা অপতৎপরতা শুরু করেছে সিন্ডিকেট।

এহেন অপতৎপরতার জেরে বিমানকে অনিয়ম ও দুর্নীতি থেকে মুক্ত করে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার যে উদ্যোগ চলমান, তা ভেস্তে যেতে পারে বলে আশঙ্কা খোদ বিমানেরই সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। বিমানে বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে অনিয়ম-দুর্নীতি; রয়ে গেছে অব্যবস্থাপনাও। কখনই এসবের লাগাম টানা যায়নি। ফলে যাত্রী ও বহরে নতুন প্রজন্মের উড়োজাহাজ যুক্ত হলেও লোকসানের লাগাম টানা যায়নি।

এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে গত বছরের শেষ দিক থেকে শুরু হয় বিমানের ভেতর বাসা বাঁধা দুর্নীতিবাজদের সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার কাজ। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও বেসামরিক বিমান মন্ত্রণালয় এ কাজটি শুরু করে। বিমানের বিভিন্ন খাতের ধারাবাহিক দুর্নীতির লাগাম টানতে গঠন করা হয় একাধিক তদন্ত কমিটি। এর পরই ঘাটে ঘাটে ঘাঁপটি মেরে থাকা দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের শক্তি কমতে থাকে। ফলে দীর্ঘদিন পর হলেও লাভের মুখ দেখতে থাকে বিমান।

২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাসের সঙ্গে চলতি বছরের অর্থাৎ ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাসের একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ তুলে ধরলেই পরিষ্কার বোঝা যায় যে, দুর্নীতিবাজদের সিন্ডিকেটের শক্তি এখন অনেকটাই কমে গেছে। গত বছরের প্রথম ৫ মাসে বিমানের আয় হয়েছিল ১ হাজার ৩৩৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। আর চলতি বছরের গত ৫ মাসে (জানুয়ারি-মে) আয় হয়েছে ১ হাজার ৭১৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম ৫ মাসে ৩৮১ কোটি ৮ লাখ টাকা বেশি আয় হয়েছে।

মন্ত্রণালয় ও বিমানের একাধিক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেছেন, বিমানে শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে বিভিন্ন খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার লাগাম টানা শুরু হয়েছে বলেই আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। একই কারণে বেড়েছে বিমানের সেবার মানও। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও একটি গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রের খবর, শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবেই বিমানের এমডি মোসাদ্দিক আহমেদকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে; ২০ থেকে ২২ কর্মকর্তাকে করা হয়েছে ওএসডি নয়তো বদলি। এ ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে বছরের পর বছর ধরে বিমানে সক্রিয় দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। তারা এখন নিজেদের রক্ষায় দৌড়ঝাঁপ করছেন চলমান শুদ্ধি অভিযান বাধাগ্রস্ত করার হীন উদ্দেশ্যে।

এ জন্য তারা অনৈতিকভাবে উপার্জিত কোটি কোটি টাকাও ঢালছেন বিভিন্ন মহলে। এর সুবাদে ওএসডিকৃত ও বদলিকৃত কর্মকর্তাদের ফের স্বপদে বহালের অপচেষ্টা চলছে। বিমানের পরিচালনা পর্ষদের কোনো কোনো প্রভাবশালী সদস্যও এর সঙ্গে যুক্ত বলে জোর অভিযোগ রয়েছে। বিমান মন্ত্রণালয়ের একাধিক তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হলেও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মহিবুল হক কোনো মন্তব্য করতে সম্মত হননি। বিমানের ভারপ্রাপ্ত এমডি ক্যাপ্টেন ফারহাত হাসান জামিলও মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। দুদক সম্প্রতি বিমানের ৮টি খাতে দুর্নীতির প্রমাণ পায়। এগুলো হলো- এয়ারক্রাফট কেনা ও লিজ নেওয়া; রক্ষণাবেক্ষণ-ওভারহোলিং; গ্রাউন্ড সার্ভিস; কার্গো আমদানি-রপ্তানি; ট্রানজিট যাত্রী ও লে-ওভার যাত্রী; অতিরিক্ত ব্যাগেজের চার্জ আত্মসাৎ; টিকিট বিক্রি এবং ক্যাটারিং খাত।

বছরের পর বছর ধরে এই ৮ খাতে দুর্নীতি চলে আসছে। অতীতে বিভিন্ন সময়ে বিমানকে লাভজনক করতে নানা স্বপ্ন দেখানো হয়েছে বিমান কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে। কিন্তু লাভজনক হয়নি বরং অনিয়ম-দুর্নীতিতে ক্রমাগত ডুবছিল বিমান। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও বিমান মন্ত্রণালয় বিমানে শুদ্ধি অভিযান শুরু করে, যা এখনো চলমান।

একাধিক অভিযোগের যে তদন্ত ও অনুসন্ধান চালাচ্ছে দুদক তাতে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য পাওয়া যাচ্ছে বলে সূত্রের খবর। এ দুর্নীতি প্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিমানের প্রায় দুইশ কর্মকর্তা-কর্মচারী সম্পৃক্ত। তাদের মধ্যে দুদকের অনুসন্ধানে ১৪৭ জনের নাম এসেছে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, অনিয়ম ও নিয়োগবাণিজ্যের অভিযোগে।

এর মধ্যে বিদায়ী এমডি ও সিবিএ নেতাসহ ১০ জনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দুদক। এ ছাড়া দুদকের তালিকাভুক্ত ১৪৭ কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রত্যেকের গতিবিধির ওপর নজর রাখছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। পর্যায়ক্রমে তাদের জিজ্ঞাসাবাদও করা হবে দুদকের পক্ষ থেকে। দুর্নীতির অভিযোগে বিমানের বিপণন ও বিক্রয় শাখার ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আশরাফুল আলম এবং জিএম শফিকুল ইসলামকে গত ৩ এপ্রিল ওএসডি করা হয়।

আশরাফুল আলমের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সির পক্ষে বিমানের টিকিট ব্লক করে রেখে সে সব এজেন্সি থেকে সুবিধা দিয়েছেন এবং তাদেরও অনৈতিকভাবে সুবিধা নিয়েছেন। আর জিএম শফিকুল ইসলাম যুক্তরাজ্যে ৪ বছর বিমানের কান্ট্রি ম্যানেজার ছিলেন। সে সময় ২ হাজার ৪৭২টি টিকিট বিনামূল্যে বিক্রি দেখিয়ে প্রায় ১৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি। অথচ তাদেরই রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ঘরের ইঁদুরের মতো বিমানের ভেতরে ঘাঁপটি মেরে বসে থাকা দুর্নীতিবাজদের সিন্ডিকেট।

Comment here