রাষ্ট্রকাঠামোতে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ও জবাবদিহিমূলক সরকার কাঠামো সৃষ্টিতে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যে পৌঁছানোর লক্ষ্যে কাজ করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এ কমিশন এরই মধ্যে দলগুলোর সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছে। সামনে আরও বৈঠক হবে। দেশের কল্যাণে দলগুলো অনেক বিষয়ে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করে ঐকমত্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, বিরোধী দল থেকে সংসদীয় কমিটির সভাপতি করা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদসহ মৌলিক অনেক বিষয়ে দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছেছে। কিছু বিষয়ে বিএনপিসহ কয়েকটি দল আপত্তি তুলেছে। সব বিষয়ে যে ঐকমত্য হবে, এমনটাও মনে করেন না কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, দলগুলোর রাজনৈতিক, আদর্শিক অবস্থানের কারণে মতপার্থক্য থাকবে, সব বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না, এটাই বাস্তব।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চাইছে জবাবদিহিমূলক একটা সরকারব্যবস্থা চালু করতে। এ জন্য সরকারের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে- সংস্কার করে একটা অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিতর্কমুক্ত ভালো নির্বাচন উপহার দেওয়া। সরকার যেন সফলভাবে সংস্কার করে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে পারে সে লক্ষ্যে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল সমর্থন ও সহযোগিতা করে যাচ্ছে। কিছু কিছু সংস্কার নিয়ে কমিশন ও বিএনপির মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে, যা নিয়ে আলোচনা ছড়িয়ে পড়ে সব মহলে। যার ফলে নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা আশা ও সংশয়ের কথা সামনে চলে আসে। সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনকেন্দ্রিক ধোঁয়াশা কাটাতে কথা বললেও শর্তযুক্ত কথায় আস্থাহীন রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, শর্ত দিয়ে কোনো কিছু আদায় করা যায় না। শর্ত দিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর পরিকল্পনা হলে এ সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তাই যা কিছুই হোক, আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে যৌক্তিক পর্যায়ে পৌঁছে দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করার পক্ষে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
এ বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইসমাইল জবিউল্লাহ আমাদের সময়কে বলেন, এতে নির্বাচন নিয়ে কোনো সমস্যা দেখছি না। আলোচনা অব্যাহত আছে। সামনে আরও আলোচনা হবে। তাই অগ্রিম কোনো কথা বলতে চাই না। শর্ত দিয়ে তো কিছু হবে না। আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হবে বলে আশা করি।
নির্বাচন কবে হবে, আদৌ হবে কিনা- এ রকম নানা বিতর্ক যখন রাজনীতির মাঠে চাউর হয়ে ওঠে, তখনই সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন বিষয়ে কথা বলা হয়। গেল ঈদের আগে জাতিকে আশ^স্ত করে প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা দেন, ২০২৬ সালের এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তার এ বক্তব্যে আশাহত হয় বিএনপিসহ নির্বাচনমুখী অধিকাংশ দলগুলো। এমন পরিস্থিতিতে গত ১৩ জুন লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সেই বৈঠকের পর যৌথ ঘোষণা দেওয়া হয়, সংস্কার ও বিচার প্রক্রিয়ায় অগ্রগতি হলে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোট হতে পারে। এ ঘোষণার পর বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে স্বস্তি ফিরলেও জামায়াত, এনসিপিসহ অন্যান্য দল দ্বিমত পোষণ করে। একটি রাজনৈতিক দলের নেতার সঙ্গে বৈঠক করে সরকার যৌথ ঘোষণা দিতে পারে কিনা, এ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন অনেকে। লন্ডন বৈঠকের এক মাস হতে যাচ্ছে আগামীকাল রবিবার। এ সময়ের মধ্যে সরকার ও নির্বাচন কমিশন কোনো পক্ষই নির্বাচন বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা দেয়নি। তাই এখনও নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কেটেছে বলে মনে করছেন না অনেক রাজনীতিবিদই।
নির্বাচন নিয়ে এমন দোলাচলের মধ্যে গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, নির্বাচনসংক্রান্ত যাবতীয় প্রস্তুতি ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। কিন্তু এ নির্দেশনা আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) এখনও জানায়নি সরকার। এ অবস্থায় নতুন করে বিতর্ক দেখা দিয়েছে গত বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজের বৈঠকের পর। লন্ডন ঘোষণার বাস্তবায়ন নির্ভর করছে ঐকমত্য কমিশনের প্রতিবেদনের ওপর। ওই বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা কয়েকটি সংস্কারের বিষয়ে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেন। সেখানে বলা হয়েছে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বাধীনভাবে নিরপেক্ষ নিয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, ভবিষ্যতে কোনো দল চাইলেই যাতে সংবিধান পরিবর্তন করে ফেলতে না পারে, সে ধরনের বিধান এবং নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। এসব সংস্কার নিশ্চিত করেই নির্বাচন করার পক্ষে মত দেন তিনি। এসব বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের কয়েক দফা আলোচনা হলেও এ পর্যন্ত ঐকমত্য হয়নি। এসব ক্ষেত্রে সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে বিএনপিসহ কয়েকটি দলের আপত্তি আছে। এটি নির্বাচন বিলম্বিত করার নতুন তত্ত্ব কিনা, এ নিয়েও বিতর্ক চলছে। রাজনৈতিক দলগুলো ছাড় দিয়ে হলেও ঐকমত্যের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে কিছু শর্ত জুড়ে দিয়ে পুরো আলোচনাকেই অর্থহীন করা হচ্ছে কিনা- এমন শঙ্কাও রয়েছে অনেকের মধ্যে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিয়োগের বিষয়ে যে প্রস্তাব এসেছে, এটা করতে পারলে ভালো। এক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের আধিপত্যবাদ দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই ক্ষমতাসীনরা এটা কখনও চাইবে না। কিন্তু এটাকে যদি নির্বাচনের ট্যাগ দেওয়া হয়, তা হলে সমস্যা সৃষ্টি হবে। নির্বাচনে প্রভাব পড়বে। বিষয়টি আলোচনার প্রস্তাবে রেখে অনড় অবস্থান বদলানো উচিত।
এ বিষয়ে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক আমাদের সময়কে বলেন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ প্রধানমন্ত্রী বা নির্বাহী বিভাগের বাইরে নিয়োগ কমিটির মাধ্যমে হওয়া দরকার। এটা কোনোভাবেই নির্বাহী বিভাগের ওপর ন্যস্ত করা উচিত নয়। এটা আমাদের দলের অবস্থান। অধিকাংশ দল এর সঙ্গে একমত। এমনকি সংসদের উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতির কথা বলেছি। প্রধান উপদেষ্টা হয়তো তার প্রত্যাশার কথা বলেছেন। কিন্তু এটা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার থেকে চাপাচাপি বা জবরদস্তি করার সুযোগ নেই। এসব বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে আমাদেরও সুস্পষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে। কিন্তু আমরা এটাও মনে করি, কোনো বিষয়ে জোরজবরদস্তি বা চাপাচাপি করা উচিত নয়। আলাপ-আলোচনা হতে পারে। সরকার যদি এসব বিষয়ে অনমনীয় অবস্থান নেয়, তা হলে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, শর্ত জুড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। যথাসময়ে নির্বাচনই পরিস্থিতি উত্তরণের পথ। তা যেন কেনোক্রমেই বিলম্বিত না হয়।



Comment here