উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়েও ব্যাংকে বাড়ছে আমানত। সর্বশেষ মে মাসে এ খাতে আমানত বেড়েছে প্রায় ১৫ হাজার ৩০১ কোটি টাকা। আর চলতি বছরের প্রথম ৫ মাসে (জানুয়ারি-মে) বেড়েছে প্রায় ৭৩ হাজার ৭১২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ সময়ে প্রতি মাসে গড়ে আমানত বেড়েছে প্রায় ১৪ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা। সবমিলে গত মে মাস শেষে ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৫ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আর গত এক বছরে আমানতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৮ দশমিক ৮১ শতাংশ।
ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করেন, মূলত সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে নানা কড়াকড়ি ও আমানতের সুদের হার কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়ায় কয়েক মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে আমানতের প্রবৃদ্ধি। ফলে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করেছে। যদিও আর্থিক অনিয়মের জেরে ইসলামী ধারার কয়েকটি ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি নেতিবাচক ধারায় চলে গেছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, আমানত বৃদ্ধির মূল কারণ হচ্ছে এ খাতে সুদের হার আগের চেয়ে বেড়েছে। এখন তো আর নয়ছয় সুদের সীমাবদ্ধতা নেই। ফলে ব্যাংকগুলো আমানতে এখন ৬ শতাংশেরও বেশি সুদ দিতে পারছে। আরেকটি কারণ হলোÑ নানা কড়াকড়ির কারণে দীর্ঘদিন ধরেই সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ভাটা চলছে। ফলে যারা নিয়মের মধ্যে সঞ্চয়পত্রে টাকা খাটাতে পারছেন না, তারা বিকল্প হিসেবে ব্যাংকেই টাকা রাখছেন। এ ছাড়া শেয়ারবাজারের অবস্থাও ভালো যাচ্ছে না।
দেশে গত কয়েক মাস ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। তারপরও আমানত কীভাবে বাড়ে এমন প্রশ্ন করা হলে মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আমানত বাড়লেও তার লেভেল এখনো কাক্সিক্ষত মাত্রার চেয়ে কম। এর মানে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার সঙ্গে সঞ্চয়প্রবণতাও কমেছে।
দেশে করোনার আঘাত আসার পর সাধারণ ছুটি ও কয়েক দফার লকডাউনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে অর্থনীতিতে। অনেকের রুটিরুজির পথ বন্ধ হয়ে যায়। চাকরি হারিয়ে বেকার হন অনেকেই। আবার কাজ থাকলেও বেতন কমে যাওয়া বা বেতন বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। এতে ব্যাংক খাতে আমানত কমার আশঙ্কা করা হলেও সে সময় বিনিয়োগে ধীরগতি ও রেমিট্যান্সের জাদুতে সেটি হয়নি। তবে করোনার পরিস্থিতি উন্নতির হওয়ার পর ২০২২ সালে আমানতের প্রবৃদ্ধি বেশ কমে যায়। এর জন্য উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও রেমিট্যান্সের টানা পতনকে দায়ী করেছিলেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া ওই বছরের শেষের দিকে কয়েকটি ইসলামী ব্যাংকের ঋণ অনিয়মের ঘটনা সামনে আসায় আস্থার সংকটে আমানত তুলে নেওয়ার ঘটনাও ঘটে। তবে চলতি বছর সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে ব্যাংক খাত। গত কয়েক মাস ধরে পুরনো আমানত ফেরার সঙ্গে নতুন আমানতও আসছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, সর্বশেষ মে মাস শেষে ব্যাংক খাতের আমানতের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৬৩ হাজার ৪৯৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা। গত বছরের মে মাসে এ খাতের আমানতের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৩৬ হাজার ৯৪৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এ হিসাবে গত এক বছরে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ৮১ শতাংশ। এর মধ্যে গত মে মাসেই আমানত বেড়েছে প্রায় ১৫ হাজার ৩০১ কোটি টাকা। অথচ ২০২১ সালের মে থেকে গত বছরের মে পর্যন্ত এক বছরে আমানত বেড়েছিল ১ লাখ ১২ হাজার ৪২১ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এর আগে দেশে করোনার আঘাত আসার মধ্যেও আমানতের প্রবৃদ্ধি বাড়তে বাড়তে ২০২১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ ১৪ দশনিক ৪৭ শতাংশে উঠেছিল। কিন্তু তারপর থেকে টানা কমতে থাকে আমানতের প্রবৃদ্ধি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছরের ডিসেম্বরে আমানতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি নেমে আসে মাত্র ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশে, যা ছিল ইতিহাসে এ যাবৎকালের সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি। তথ্য পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, গত বছরই সবচেয়ে কম বাড়ে ব্যাংকের আমানত। ওই বছর ব্যাংকের আমানত বাড়ে মাত্র ৮৯ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত বছরের প্রথম ৫ মাসে আমানত বেড়েছিল মাত্র ২৭ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা। সেখানে চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে আমানত বেড়েছে প্রায় ৭৩ হাজার ৭১২ কোটি টাকা। এর মানে গত বছরের প্রথম পাঁচ মাসের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে আড়াইগুণেরও বেশি বেড়েছে আমানত।
বাড়ছে আমানতের সুদ: চলতি বছরের জানুয়ারিতে ঘোষণা করা ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতিতে আমানতের সুদের সীমা উঠিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই ঘোষণার পর থেকে ব্যাংকগুলো প্রতি মাসেই একটু একটু করে আমানতের সুদ বাড়িয়ে আসছে। এখন অনেক ব্যাংক আমানতে ৬ থেকে ৭ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে। এতে ব্যাংক খাতে গড় আমানতের সুদও বাড়ছে। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, গত জানুয়ারিতে ব্যাংক খাতে আমানতের গড় সুদহার ছিল ৪ দশমিক ২৯ শতাংশ, যা গত মেতে বেড়ে হয়েছে ৪ দশমিক ৪১ শতাংশ।
কড়াকড়িতে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ভাটা: ২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। তবে বিক্রিতে ভাটা পড়ায় সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৩২ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, সদ্য বিদায় নেওয়া অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) সঞ্চয়পত্র বিক্রির চেয়ে বেশি ভাঙানো হয়েছে প্রায় ৩ হাজার ২৯ কোটি টাকা। এর মানে আলোচ্য সময়ে সঞ্চয়পত্র থেকে কোনো ঋণই পায়নি সরকার, উল্টো আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের নগদায়নের চাপে ঋণ পরিশোধ বেড়েছে।
মূলত ২০১৯ সালের জুলাই থেকে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে বিভিন্ন কড়াকড়ি আরোপ করে আসছে সরকার। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ থাকলে আয়কর রিটার্নের সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর আগে ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। এরপর ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার। এ ছাড়া ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ সীমা কমিয়ে আনা হয়।
কমে যাচ্ছে ঋণের প্রবৃদ্ধি: ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধি বাড়লেও ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। গত মে শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৭০ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা, যা ২০২২ সালের মেতে ছিল ১৩ লাখ ২৩ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। ফলে গত এক বছরে বেসরকারি খাতে ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা বা ১১ দশমিক ১০ শতাংশ। জানা যায়, গত বছরের আগস্টের পর থেকেই বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা আছে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ।
Comment here