কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা চলাকালে দলের নীরব ভূমিকা ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারায় স্পষ্ট ক্ষত দৃশ্যমান হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে। দেশব্যাপী এই আন্দোলনে দলের হাতেগোনা কিছু নেতাকর্মী ছাড়া বেশিরভাগ নেতাকর্মী ছিলেন নিষ্ক্রিয়। আন্দোলন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পরই দফায় দফায় নেতাকর্মীদের নিয়ে বসছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। যদিও এতে তেমন ফল বয়ে আনছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট নেতারা। তাদের ভাষ্য, কেন্দ্র থেকে শুরু করে মহানগর ও কিছু জেলায় শীর্ষ নেতাদের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন নেতাকর্মীরা। সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে দলের মতবিনিময় সভাগুলোতে। ক্ষুব্ধ নেতারা বলেছেন, এই মতবিনিময় সভা কোনো কাজে আসবে না যদি দলকে নতুন করে সাজানো না হয়। তৃণমূল নেতাদের মতে, দলের এই ভঙ্গুরদশার জন্য কেন্দ্রীয় নেতারা দায়ী। এরপর দায়ী তৃণমূলের সুবিধাভোগীরা।
গত কয়েক দিন দলের মতবিনিময় সভাগুলোতেও এক নেতা অন্যকে দোষারোপ এবং ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। গত শুক্রবার ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ অফিসে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় এটি আরও স্পষ্ট হয়। বিশেষ করে থানা ও ওয়ার্ডের পাঁচ নেতার বক্তব্যে দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা মহানগরের রাজনীতির ‘বেহাল’ চিত্র ফুটে উঠেছে। শুধু তাই নয়, কে মাঠে ছিলেন আর কে ছিলেন না- এ নিয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম মান্নান কচি ও ঢাকা-১৪ আসনের সংসদ সদস্য মাইনুল হোসেন খান নিখিলের মধ্যে ব্যাপক বাকবিতণ্ডা হয়। এটি শেষ পর্যন্ত গালাগালের পর্যায়ে গড়ায়। এর আগেও ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক এসএম মান্নান কচির মধ্যে গালাগালের ঘটনা ঘটে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণের অবস্থা আরও ভয়াবহ। দক্ষিণের দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে কোনো ধরনের সমন্বয় নেই। এমনকি থানা ওয়ার্ডের কমিটি দেওয়ার সময়ও তারা আলাদা আলাদা তালিকা দিয়েছেন।
এ ছাড়া সম্প্রতি সাংগঠনিক রীতি উপেক্ষা করে দলের তিন নেতার সিদ্ধান্তে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের মোহাম্মদপুর, আদাবর ও শেরেবাংলা নগর থানার ১০৮টি ইউনিট কমিটির মধ্যে ২৬টি কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু একই দোষে অন্য এলাকার পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এ নিয়েও মহানগরে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
কোটা আন্দোলন ঘিরে সাম্প্রতিক সংঘাতের সময়ে ঢাকায় দলের বড় দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে মালিবাগ থেকে বাড্ডা পর্যন্ত এলাকায়। রামপুরা বনশ্রী এলাকায় টানা তিন দিন ছিল ভীতিকর অবস্থা। বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে শুরু করে, পিবিআই অফিস ও থানা ঘেরাও করে সহিংসতা চালায় দুর্বৃত্তরা। ভাঙচুর করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ অফিসও। কিন্তু ঢাকা-১১ আসনের অন্তর্ভুক্ত মালিবাগ, বাড্ডা, রামপুরা এলাকার সংসদ সদস্য ওয়াকিল উদ্দিনের নেতৃত্বে কোনো নেতাকর্মীকে বের হতে দেখা যায়নি। এমনকি তাকে কেন্দ্র থেকে ডাকা হলেও হাজির হননি।
এদিকে আন্দোলন চলাকালে ঢাকা-৫ ও ঢাকা-৪ আসনের অন্তর্ভুক্ত এলাকা চট্টগ্রাম রোড, শনির আখড়া, কদমতলী এলাকায়ও ব্যাপক সহিংসতা চালায় দুর্বৃৃত্তরা। এক পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখা হয়। ওই পরিস্থিতিতে এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের দৃশ্যমান কোনো অবস্থান ছিল না। শুধু ডেমরা এলাকায় ঢাকা-৫ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য অবস্থান করায় সেখানে দুর্বৃত্তরা দাঁড়াতে পারেনি। মোহাম্মদপুর এলাকায়ও সহিংসতা রোধে আওয়ামী লীগ নেতারা কোনো ভূমিকা রাখেননি। ফলে তিন দিন ধরে ‘দুর্বৃত্তরা’ মাঠ দখলে রেখে তা-ব চালায়। অবশ্য ঢাকার অন্যতম প্রবেশদ্বার গাবতলী এলাকায় ঢাকা-১৪ আসনের সংসদ সদস্য ও যুবলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিলকে মাঠে দেখা গেছে। মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক এমপি সাবিনা আক্তার তুহিন নেতাকর্মীদের নিয়ে মাঠে ছিলেন। ওই সময় মহানগরের দুই শীর্ষ নেতাকে পার্টি অফিস বা নীতি-নির্ধারণীয় মহলের সঙ্গে সভা করা ছাড়া কোথাও অবস্থান নিতে দেখা যায়নি। অন্যদিকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণে পুরান ঢাকা ছাড়া সে অর্থে কোথাও নেতাকর্মীদের অবস্থান নিতে দেখা যায়নি। দক্ষিণের দুই শীর্ষ নেতাকে মাঠে পাওয়া যায়নি।
রাজধানীর উত্তরায় ঢাকা-১৮ আসনের এমপি খসরু চৌধুরী প্রথম দিন স্বল্পসংখ্যক নেতাকর্মী নিয়ে মাঠে নামেন। নিজস্ব বলয় নিয়ে মাঠে নামেন ঢাকা মহানগর উত্তরের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হাবিব হাসান। কিন্তু অন্য কাউন্সিলরদের মাঠে দেখা যায়নি। ওই এলাকায় ব্যাপক ভাঙচুর চালায় দুর্বৃত্তরা।
আবার ঢাকার অদূরে গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জেও ছিল বেহাল অবস্থা। নারায়ণগঞ্জে শামীম ওসমান ছাড়া বলা যায় কোনো নেতাই অবস্থান নেননি। ফলে পার্টি অফিস ভাঙচুরসহ হাইওয়ে রাস্তার আশপাশের বিভিন্ন স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেয় দুর্বৃত্তরা। গত ১৮ জুলাই তা-ব চালানো হয় নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায়। হামলা চালানো হয় নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে। এক নেতা বলেন, ২২ বছর আগে হওয়া ৬৭ সদস্যের কমিটির ২৬ জনই এখন মৃত। ফলে এ এলাকা সামাল দেওয়ার মতো তেমন নেতা নেই বললেই চলে। আরেক নেতা জানান, টানা চারবারের ক্ষমতায় থাকায় নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনগুলোতে হাইব্রিড নেতাদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। বিপরীতে অবহেলিত হয়েছেন ত্যাগী নেতাকর্মীরা। যে কারণে দলের বেহাল অবস্থা। অন্যদিকে গাজীপুরে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। গাজীপুর সিটি করপোরশেনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম দুর্বৃত্তদের হামলায় শঙ্কটাপন্ন অবস্থায় আছেন।
আন্দোলনে রংপুরে আওয়ামী লীগ ছিল না বলেই চলে। ফলে পার্টি অফিস ভাঙচুর থেকে শুরু করে নেতাকর্মীদের বাড়ি পর্যন্ত ভাঙচুর করেছে আন্দোলনকারীরা। রংপুরের এক নেতার ভাষ্য- দীর্ঘ ১৬ বছরের আওয়ামী লীগের শাসনামলে রংপুরে কিছু ‘হাইব্রিডদের’ ভিড়ে বরাবরই উপেক্ষিত হচ্ছেন ‘ত্যাগী ও যোগ্য’ নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগের ঘাঁটিখ্যাত ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের ইতিহাসে এই প্রথম দলীয় কার্যালয় ও শীর্ষ দুই নেতারা বাড়িতে হামলা হয়েছে। স্থানীয়রা বলেছেন, ময়মনসিংহ জেলা ও মহানগরের রাজনীতিতে কোন্দল চরমে। অনেক ত্যাগী নেতাকে বাদ দিয়ে কমিটি করেছেন। এর জন্য কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা দায়ী।
ময়মনসিংহের শিল্পাঞ্চল বলে খ্যাত ভালুকায় ২০০২ সালের পর আর কমিটি হয়নি। আবার গৌরীপুরে সাবেক এমপি ও বর্তমান এমপির মধ্যে কোন্দল চরমে। মাদারীপুরেও কোন্দলের জেরে প্রতিবাদী অবস্থায় ছিল না আওয়ামী লীগ। দলের একজন শীর্ষ পর্যায়ের নেতার বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে।
নরসিংদী এলাকার রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের অবস্থান অনেক বছর ধরেই নড়বড়ে। যে কারণে ওই এলাকায় জেলখানায় হামলা করে আসামি ছিনতাই, থানা ও মার্কেট পোড়ানোসহ বড় তা-ব চালায় দুর্বৃত্তরা। সেখানে আওয়ামী লীগ নেতাদের মাঠে দেখা যায়নি।
আওয়ামী লীগের এক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, কেন্দ্র থেকে মহানগর, সহযোগী সংগঠন এবং তৃণমূল পর্যায়ে সমন্বয়হীনতা দেখা যাচ্ছে। এটা হয়েছে সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে। এর দায়ভার সবার আগে দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতাদের। দ্রুত নেতৃত্বের পরিবর্তন আনা জরুরি, বিশেষ করে ঢাকা মহানগরে। এমন ভাষ্য কেন্দ্রীয় ও নগরের আরও অন্তত ১০ নেতার।
এমন সমন্বয়হীনতা থেকে উত্তরণের বিষয়ে জানতে চাইলে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, দলে সমন্বয় আছে কি নাই- এটা বলার সময় এখন না। এখন আমাদের প্রথম ও প্রধান কাজ হলো উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা করা।
Comment here