নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বেকারিতে সংঘটিত ভয়াবহ ও নৃশংস জঙ্গি হামলা মামলার রায় আজ বুধবার হতে যাচ্ছে। ২০১৬ সালের ১ জুলাই ওই হামলায় ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২৩ জন নিহত হয়েছিলেন।
তবে ভয়াবহ এই হামলার সময় জঙ্গিরা ভেতর থেকে বাইরে তাদের সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। কীভাবে সেই রাতে তারা সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল, কীভাবে পাঠিয়েছিল রক্তাক্ত ছবি-সেই প্রশ্নের উত্তর মিলেছে এই মামলার তদন্তে।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজান বেকারিতে হত্যাকাণ্ড চালানোর পর সেখানে অবস্থানরত এক শ্রীলঙ্কানের মোবাইল ফোন ব্যবহার করে বাইরে যোগাযোগ করে নব্য জেএমবির জঙ্গিরা। আবু তালহা নাম ব্যবহার করে একজন বাইরে থেকে জঙ্গিদের সঙ্গে বার্তা আদান-প্রদান করে।
অভিযান শেষে হলি আর্টিজান বেকারি থেকে আলামত হিসেবে মোট ২৮টি মোবাইল জব্দ করা হয়। তার মধ্যে হরিকেশা বিজেসেকেরা নামের এক শ্রীলঙ্কানের আইফোন থেকে বার্তা আদান-প্রদানের প্রমাণ পান সিআইডির ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা।
ওই মোবাইল থেকে ‘প্রটেকটেডটেক্স’ নামে একটি এপ্লিকেশন ব্যবহার করে রাত ১২টা ৪১ মিনিট ৪৪ সেকেন্ড থেকে রাত ২টা ৩৬ মিনিট ৩১ সেকেন্ড পর্যন্ত ১০টি বার্তা আদান-প্রদান করে জঙ্গিরা।
এর মধ্যে শুধু একটি বার্তা পুরোপুরি উদ্ধার করা সম্ভব হয়। বাকিগুলো পাওয়া গেছে আংশিক, তবে তাতেই হত্যাকাণ্ডের বার্তা দেওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়।
বার্তাগুলোর যে অংশবিশেষ পড়া গেছে, তাতে লেখা ছিল-‘বনানী ওসি কিলড…’, ‘২২ সেন্ট টু হেল…’, ‘আপনারা তামকিন…’, ‘এটা অফিসিয়াল…’, ‘হাউ আর দ্যা…’ ইত্যাদি। সবগুলো বার্তার শুরুতে লেখা ছিল ‘আখি’।
সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবের কর্মকর্তাদের ধারণা, জঙ্গিদের মধ্যে হলি আর্টিজান বেকারির ভেতর থেকে যোগাযোগ রাখছিলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র নিবরাজ ইসলাম।
রাত ২টা ১৪ মিনিটে ‘আবু তালহা’ নামে একজনের কাছ থেকে আসা বার্তাটিই পুরোপুরি উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন গোয়েন্দারা।
সেখানে ইংরেজি হরফে লেখা ছিল-‘আখি আপনারা কোন পিকচার বা ভিডিও আপলোড করতে পারবেন নেটে? তারপর আমাদের লিংক দিলেই হবে।”
তদন্তকারীদের ধারণা, আবু তালহা নাম নিয়ে যিনি বাইরে থেকে যোগাযোগ করছিলেন, তিনি নব্য জেএমবির তখনকার শীর্ষ নেতা তামিম চৌধুরী বা তার অন্যতম সহযোগী নুরুল ইসলাম মারজান।
ইন্টারনেটে জঙ্গি কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারি করা আন্তর্জাতিক সংস্থা সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ সেদিন রাত ১২টার দিকে খবর দেয়, হলি আর্টিজান বেকারির হামলাকারী হিসেবে পাঁচ তরুণের ছবি প্রকাশ করেছে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের মুখপাত্র আমাক।
পরদিন সকালে কমান্ডো অভিযানে নিহত হন সেই পাঁচ তরুণ। পরে তাদের পরিচয়ও জানা যায়। তারা হলেন-রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাস ইসলাম, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম।
সেদিন রাত পৌনে ৯টায় হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা শুরুর পর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই নব্য জেএমবির এই জঙ্গিরা ধারালো অস্ত্রের আঘাতে বা গুলি করে ২০ জনকে হত্যা করে, যাদের মধ্যে ১৭ জনই ছিলেন বিদেশি। বেকারির ভেতরে হত্যাযজ্ঞের রক্তাক্ত সেই ছবিও গভীর রাতে দেখানো হয় আইএসের মুখপাত্র আমাকে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক হুমায়ূন কবীর বলেন, জঙ্গিরা নিজেদের মধ্যে কোনো বিষয়ে আলোচনার আগে ‘আখি’ বলে সম্বোধন করতো। এটা তাদের সম্বোধন সূচক শব্দ। শুধু হলি আটিজান হামলার সময় নয়, আরও অনেক ঘটনায় তাদের মধ্যে এই শব্দটির ব্যবহার দেখা গেছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, হলি আর্টিজান থেকে উদ্ধার করা মোট ২৮টি মোবাইল, নয়টি ল্যাপটপ, তিনটি আইপ্যাড, দুটি ডিজিটাল ক্যামেরা, একটি আইপ্যাড, একটি এক্সটার্নাল হার্ডডিক্স সিআইডিতে ফরেনসিক পরীক্ষা করা হয়।
জঙ্গিদের হামলা-হত্যাকাণ্ডের সময় পরিবার নিয়ে ওই রেস্তোরাঁয় থাকা নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আবুল হাসনাত রেজাউল করিমের মোবাইল ও ল্যাপটপও সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়।
সেগুলোতে হামলার আগে বা পরে তার জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগপত্রে জানানো হয়েছে।
তদন্ত কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, হাসনাত করিম তার মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে হলি আর্টিজান বেকারিতে গিয়েছিলেন পরিবার নিয়ে। হামলার পর এক পর্যায়ে জিম্মিদশার মধ্যে তারা জঙ্গিদের কথা মতো চলতে বাধ্য হন। জঙ্গি রোহান ইবনে ইমতিয়াজ পরদিন ভোরে হাসনাতকে অস্ত্রের মুখে ছাদে নিয়ে যায়। সেই সময়ের ছবিই পরে প্রকাশিত হয়।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, হলি আর্টিজানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর জঙ্গি নিবরাস ইসলাম জিম্মিদের কারও মোবাইলে ইন্টারনেট সংযোগ আছে কি না জানতে চান। হাসনাত করিম তার মোবাইলে ইন্টারনেট থাকার কথা জানালে নিবরাজ তাকে প্লে স্টোরে গিয়ে Wickr ME Secure Messenger নামে একটি অ্যাপ ইন্সটল করতে বলেন।
নিবরাজ এরপর ফোনটি নিজের কাছে রেখে দেন এবং পরদিন সকালে কমান্ডো অভিযানের আগে হাসনাত করিমকে ফিরিয়ে দেন বলে তদন্তকারীদের ভাষ্য।
সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন থান্ডারবোল্টে’ নিহত পাঁচ হামলাকারী ছাড়াও পরবর্তী সময়ে র্যাব-পুলিশের অভিযানে তামিম আহমেদ চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মারজান, সারোয়ান জাহান মানিক, তানভীর কাদেরী, বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট, রায়হান কবির ওরফে তারেক, মেজর (অব) জাহিদুল ইসলাম ওরফে মুরাদ ও মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান নিহত হয়। বর্তমানে আট আসামি রায়ের অপক্ষোয় আছে।
Comment here