বরিশাল প্রতিনিধি : বিকালে বরিশালের হিজলা উপজেলায় স্বামীর পরকীয়া প্রেমে বাধা হয়ে দাঁড়ানোয় ইসরাত জাহান ইমা নামে এক গৃহবধূর হাত-পা বেঁধে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে স্বামীর বিরুদ্ধে। ওই গৃহবধূ দুই সন্তানের মা এবং তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন।
গত ১১ জুন উপজেলার বড়জালিয়া ইউনিয়নের খুন্না গোবিন্দপুর গ্রামের টেকের বাজার সংলগ্ন এলাকায় গৃহবধূ ইমাকে পোড়ানোর ঘটনা ঘটে। পরে ১৮ জুন রাজধানীর শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
অভিযোগ উঠেছে, হত্যার ঘটনাটি আড়াল করতে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন ওই গৃহবধূর স্বামী মুদি দোকানী মহসিন রেজা। রাজধানীর শাহাবাগ থানায় কর্মরত হিজলার বাসিন্দা এক পুলিশ কনস্টেবলের সহযোগিতায় ময়না তদন্ত ছাড়াই ঢাকা থেকে ১৮ জুন রাতে লাশ গ্রামের বাড়িতে এনে তড়িঘড়ি করে দাফন করা হয়।
তবে মৃত্যুর আগে ইমার মায়ের মোবাইল ফোনে ধারণকৃত ১১ সেকেন্ডের ভিডিও রেকর্ড প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে হত্যার চাঞ্চল্যকর ঘটনা। ওই ভিডিও রেকর্ডের ওপর ভিত্তি করে গত রোববার হত্যা মামলা দায়ের করেছেন গৃহবধূর বাবা শফিকুল ইসলাম মাসুম।
মামলায় ইমার স্বামী মহসিন রেজা, ভাসুর মোস্তফা বেপারী, বাবা দেলোয়ার হোসেন বেপারী ও পরকীয়া প্রেমিকা শাহনাজ বেগমকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
এদিকে মামলা দায়েরের ঘটনা জানাজানি হলে আত্মগোপনে চলে যায় আসামিরা।
মামলা দায়ের ও আসামীদের গ্রেপ্তারের অভিযান চলছে বলে দৈনিক আমাদের সময়কে জানিয়েছেন হিজলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অসীম কুমার সিকদার।
মামলার বরাত দিয়ে তিনি জানান, আট বছর আগে উপজেলার হরিনাথপুর ইউনিয়নের মহিষখোলা গ্রামের শফিকুল ইসলাম মাসুমের মেয়ে ইসরাত জাহান ইমার সঙ্গে বিয়ে হয় উপজেলা সদর খুন্না গোবিন্দপুর ট্যাকের বাজারের মুদি ব্যবসায়ী ছেলে মহসিন রেজার। আট বছরের দাম্পত্য জীবনে তাদের ৫ বছরের একটি মেয়ে ও দেড় বছরের ছেলে সন্তান রয়েছে। তাছাড়া তিনমাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন গৃহবধূ।
পরে খালাতো বোন শাহনাজ বেগমের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন মহসিন। ইমা স্বামীর পরকীয়া প্রেমের ইতিহাস জেনে ফেলায় প্রায়শই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ বাধত। মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় ইমাকে।
এরই জের ধরে গত ১০ জুন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। খবর পেয়ে ইমার মা ইয়াসমিন বেগম মেয়ের স্বামীর বাড়িতে যান। ওইদিন শাশুড়ির সামনেই স্ত্রীকে মারধর করে মহসিন রেজা।
এ ঘটনার পরদিন ১১ জুন ইমার মা বাড়ি চলে যাওয়ার সময় জামাতা মহসিনকে ফোন করে আসতে বলেন। সে না আসায় রাগ করে মেয়ের বাড়ি থেকে চলে যান তিনি। এই ঘটনার কিছু সময় পরেই অর্থাৎ আসরের নামাজের সময় মহসিন তার শ্বশুরকে ফোনে জানায় ইমার মৃত্যুর সংবাদ।
পরে স্থানীয় শিপন ও রফিক নামের দুই যুবক তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলেও স্ত্রীর খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেনি মহসিন রেজা।
অপরদিকে ঘটনার খবর পেয়ে ওই দিনই পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। তখন তাদের বলা হয় এটি দুর্ঘটনা। রান্না ঘরে গ্যাসের আগুনে পুড়ে দগ্ধ হয়েছেন ইমা।
অপরদিকে ইমার অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে প্রথমে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে এবং পরবর্তীতে ওই দিন রাতেই তাকে অ্যাম্বুলেন্স যোগে রাজধানীর শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে প্রেরণ করা হয়।
১২ জুন সকালে তাকে ওই হাসপাতালে ভর্তি করার হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৮ জুন সকালে ইমা মারা যান।
ইমার চাচা মাজহারুল ইসলাম দৈনিক আমাদের সময়কে জানান, মৃত্যুর পূর্বে ইমা তার ওপর নির্যাতন এবং পুড়িয়ে মারার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে গেছেন। যার ১১ সেকেন্ডের একটি ভিডিও রেকর্ড রয়েছে। এর পরেও ইমার মাকে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখানো হয় মৃতদেহ নিয়ে। তাই হত্যার বিষয়টি গোপন করে দুর্ঘটনার কথা বলে শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিট থেকে ময়না তদন্ত ছাড়াই মৃতদেহ হিজলায় নিয়ে আসা হয়।
লাশ ময়নাতদন্ত না করে ছাড়িয়ে আনার বিষয়ে রাজধানীর শাহাবাগ থানায় কর্মরত এক পুলিশ কনস্টেবলের যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন নিহতের স্বজনরা। যার বাড়িও হিজলা উপজেলায় বলে জানান মাজহারুল ইসলাম।
১১ সেকেন্ডের ওই ভিডিও রেকর্ডে শোনা যায় গৃহবধূ বলে গেছেন তাকে হত্যার পরিকল্পনার কথা। পরকীয়া প্রেমের জের ধরে প্রথমে চেয়ার দিয়ে পিটিয়ে আহত করা হয় ইমাকে। মারধরের কারণে অচেতন হয়ে পড়া গৃহবধূকে হাত-পা বেঁধে তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে ভিডিও রেকর্ডে গৃহবধূ উল্লেখ করে গেছেন।
সর্বশেষ মৃতদেহ দাফনের তিন দিন পরে অর্থাৎ ২১ জুন হিজলা থানায় গৃহবধূর বাবা ভিডিও রেকর্ড দেখিয়ে মামলা করেন।
প্রত্যক্ষদর্শী এবং স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, একটি ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকতেন ইমা ও তার স্বামী। ঘটনার দিন বিকালে ইমার চিৎকার শুনে একই ভবনের দুই প্রতিবেশী ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তারা ইমাকে আগুনে পুড়তে দেখে নিজেদের ঘর থেকে পানি এনে তা দিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলেন। এ সময় ইমার স্বামী ঘটনাস্থলে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ‘ইমা নেই, ইমা নেই’ বলে কান্নার অভিনয় করছিলেন। তার কান্নাও প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে সন্দেহজনক মনে হয়। তাছাড়া চিৎকার শুনে পার্শ্ববর্তী ব্যবসায়ীরা তার বাড়িতে প্রবেশের চেষ্টা করলেও তাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়নি মহসিন রেজা।
ওসি অসীম কুমার সিকদার বলেন, আমরা ১১ সেকেন্ডের একটি ভিডিও রেকর্ড পেয়েছি। যেখানে নিহত গৃহবধূ ইমা মৃত্যুর কিছুটা বর্ণনা দিয়ে গেছেন। এতে কিছুটা হলেও স্বামীকে ইঙ্গিত করেছেন। আমরা মামলা নিয়েছি। আসামিদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তাছাড়া আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে গৃহবধূর মৃতদেহ কবর থেকে উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত করা হবে বলেও জানান তিনি।
Comment here