হাতিরঝিলের সেই অজ্ঞাত লাশের রহস্য উদঘাটন হলো যেভাবে - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
ঢাকাসমগ্র বাংলা

হাতিরঝিলের সেই অজ্ঞাত লাশের রহস্য উদঘাটন হলো যেভাবে

অনলাইন ডেস্ক : রাজধানীর হাতিরঝিল থেকে গত সোমবার সকাল ৭টার দিকে অজ্ঞাতনামা এক যুবকের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। হাতিরঝিল লেকের মেরুল-বাড্ডা প্রান্ত থেকে উদ্ধার হওয়া ওই যুবকের  হাত-পা রশি দিয়ে বাঁধা ছিল। বেডশিট-মশারি ও পলিথিনে মোড়ানো ছিল পুরো শরীর। অবশেষে ওই অজ্ঞাত লাশের রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। এ রহস্য উদঘাটনের বিস্তারিত ‘ডিসি তেজগাঁও-ডিমএমপি’ ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে তুলে ধরেছে পুলিশ।

পোস্টে বলা হয়, ওই যুবকের মুখমন্ডল, হাত, আঙ্গুল ও শরীরের বিভিন্ন স্থান ছিল বিকৃত। যে কারণে ফিঙ্গার প্রিন্ট সংগ্রহের মাধ্যমেও তার পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। হাতিরঝিল লেকের যে স্থানে এ মৃতদেহটি ভেসে ছিল সেখান থেকে প্রায় ৫০ মিটার উত্তরে লেকের পানি ঘেষে পড়ে থাকা একটি ছেঁড়া কাগজে লেখা একটি মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে মৃত ব্যক্তির পরিচয় শনাক্তের পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডে জড়িত আসামিদের গ্রেপ্তার করে হাতিরঝিল থানা পুলিশ।

মৃত ব্যক্তির নাম আজিজুল ইসলাম মেহেদী। বয়স ২৪ বছর। তিনি আন্তর্জাতিক ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র ছিলেন। আমেরিকা প্রবাসী বাবার একমাত্র ছেলে তিনি। আজিজুল ইসলাম মেহেদীর জন্ম চট্টগ্রাম জেলার সন্দীপের বাউরিয়া গ্রামে হলেও বেশ কয়েক বছর ধরে মাকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রামের ফিরোজ শাহ এলাকায় থাকতেন তিনি। লেখাপড়া শেষ করে কানাডায় যাওয়ার ইচ্ছা ছিল তার। লেখাপাড়ার পাশাপাশি পরিচিতজনদের পাসপোর্ট ও ভিসা প্রসেসিংয়ে সহায়তা করতেন মেহেদী।

গত মঙ্গলবার তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের এডিসি হাফিজ আল ফারুকের নেতৃত্বে এসি আশিক হাসান, হাতিরঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রশীদ, ইন্সপেক্টর মহিউদ্দিন, এসআই আতাউল ও এএসআই তরিকুল ইসলামের একটি টিম রাত ১টা ২০ থেকে ভোর ৬টা ৪০ পর্যন্ত খিলক্ষেত থানাধীন উত্তরপাড়া এলাকা থেকে এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত আসামি আহসান ও তামিমকে গ্রেপ্তার করে। আর হাতিরঝিল থানাধীন মহানগর আবাসিক এলাকা থেকে আলাউদ্দিন এবং রামপুরা এলাকা থেকে রহিমকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃত আহসান, আলাউদ্দিন ও রহিম বিজ্ঞ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

আহসানের জন্ম চট্টগ্রাম জেলার সন্দীপের বাউরিয়া গ্রামে। তিনি নিহত আজিজুল ইসলামের বাল্যবন্ধু। পাঁচ বছর মালেশিয়ায় থেকে গত বছরের ডিসেম্বরে তিনি বাংলাদেশে ফেরেন। চলতি বছরের মার্চে ঢাকার গুলশান-২ এ অবস্থিত ‘দ্য গ্রোভ’ রেস্টুরেন্টে মাসিক ৬৫,০০০ টাকা বেতনে এক্সিকিউটিভ শেফ হিসেবে যোগদার করেন আহসান। তবে করোনায় রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আর্থিক সংকটে পড়েন আহসান। তখন তিনি তার স্ত্রীর আত্মীয় এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত অপর আসামি আলাউদ্দিনের কাছে কিছু টাকা ধার চায়।

আলাউদ্দিন পেশায় ড্রাইভার হলেও পাসপোর্ট অফিসে দালালি ও পরিবহন পুলের পুরাতন গাড়ি ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আলাউদ্দিন আহসানকে টাকা ধার না দিয়ে পাসপোর্ট সংক্রান্ত কাজ (নামের বানান সংশোধন, জন্ম তারিখ সংশোধন, বয়স বাড়ানো কমানো) দিতে বলেন। এ কাজে যে টাকা পাওয়া যাবে দুজনে ভাগ করে নিবেন বলে ঠিক করেন।

গ্রেপ্তার হওয়া চার আসামি

আহসান তার বাল্যবন্ধু আজিজুল ইসলাম মেহেদীকে জানান, পাসপোর্টে সমস্যা সংক্রান্ত কোনো কাজ থাকলে তিনি সমাধান করে দিতে পারবেন। চট্টগ্রামের তিনটি পাসপোর্টের নাম ও বয়স সংশোধনের জন্য গত ১২ আগষ্ট ঢাকায় আহসানের কাছে আসেন মেহেদী। মেহেদী আলাউদ্দিনকে এ বিষয়টি জানালে আলাউদ্দিন তার গাড়িতে আহসান ও মেহেদীকে মহানগর আবাসিক এলাকায় অবস্থিত তার বাসায় নিয়ে যান। দুই সপ্তাহের মধ্যে পাসপোর্ট তিনটির নাম ও বয়স সংশোধন করে দেওয়ার আশ্বাসে আলাউদ্দিনকে ১,৮০,০০০ হাজার টাকা ও আহসানকে ১,০০০০০ টাকা দেন মেহেদী।

রাজধানীর আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত উচ্চমান সহকারী পদমর্যাদার এক ব্যক্তিকে আর্থিক সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে পাসপোর্টে নাম ও বয়স সংশোধনের কাজ করতেন আলাউদ্দিন। পাসপোর্ট তিনটি সংশোধনের জন্য পাসপোর্ট অফিসের সেই ব্যক্তিকে দিলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তিনি কাজ কতে দিতে পারেননি।  মেহেদী এ জন্যআহসান ও আলাউদ্দিনকে চাপ দেন। পরবর্তীতে আহসান ও আলাউদ্দিন মেহেদীর কাছে এক সপ্তাহ সময় চেয়ে নেন। এই সময়েও পাসপোর্ট সংশোধনের কাজ করতে ব্যর্থ হওয়ায় আলাউদ্দিন ও আহসানের কাছে পাসপোর্ট ও টাকা ফেরত চান মেহেদী।

আহসান ও আলাউদ্দিন পাসপোর্ট ও টাকা ফেরত না দিয়ে সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন। একপর্যায়ে মেহেদী এ দুজনকে জানান, পাসপোর্ট ও টাকা ফেরত না দিলে ঢাকায় এসে তাদের অফিসে অভিযোগ করবেন। চাকরি হারানোর ভয়ে আহসান ও আলাউদ্দিন মেহেদীকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আহসান ও আলাউদ্দিন পাসপোর্ট নেওয়ার জন্য মেহেদীকে গত ১০ অক্টোবর ঢাকায় আসতে বলেন।

১০ অক্টোবর বেলা ১১টা ১০ এ চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছেন মেহেদী। হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা মোতাবেক আহসান মেহেদীকে খিলক্ষেত উত্তরপাড়ায় অবস্থিত তার ভাড়া বাসায় নিয়ে যান। সেখানে খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয় মেহেদীকে। রাত আনুমানিক ১ টা ৩০ এর দিকে ঘুমন্ত মেহেদীকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে তার হাত, পা রশি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে বেডশিট, মশারি ও পলিথিনে মুড়িয়ে মোবাইল ফোনে আলাউদ্দিনকে হত্যার বিষয়টি নিশ্চিত করেন আহসান। তার আগে ৮ অক্টোবর আলাউদ্দিন পেশাগত কাজে সিলেটে যান। নিজেকে সন্দেহের বাইরে রাখতে ঢাকার বাইরে অবস্থাকালীন সময়ে মেহেদীকে হত্যার পরিকল্পনা করে আহসানের মাধ্যমে মেহেদীকে ঢাকায় আসতে বলেন আলাউদ্দিন।

আহসানের পাশের রুমের ভাড়াটিয়া তামিম (‘দ্য গ্রোভ’ রেষ্টুরেন্টে কর্মরত কলিগ) আকস্মিকভাবে আহসানের রুমে ঢুকে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি জানতে পারেন। আহসানের অনুরোধের প্রেক্ষিতে তামিম জানান এ বিষয়টি সে কাউকে বলবে না এবং লাশটি সুবিধাজনক স্থানে ফেলে দিতে আহসানকে সহায়তা করবেন।

লাশ সরিয়ে ফেলার জন্য ভোর চারটার দিকে আলাউদ্দিন খিলক্ষেত উত্তরপাড়ায় আহসানের বাসায় গাড়ি পাঠান। আহসান ও তামিম ড্রাইভারকে গাড়িতে বসতে বলে নিজেরাই মালামাল গাড়িতে তুলবে জানালে ড্রাইভার তাদের মালামাল গ্রহনে অস্বীকৃতি জানায়। পাশাপাশি ফজরের নামাজ শেষ হওয়ায় লোক সমাগম বেড়ে যাওয়ায় গাড়ি ছেড়ে দেন আহসান।

লাশ বিছানার নিচে রেখে দুপুর বারোটার দিকে ‘দ্য গ্রোভ’ রেষ্টুরেন্টে ডিউটিতে যান আহসান ও তামিম। কাজ শেষে দুজন একসঙ্গে বাসায় ফেরেন। রাত একটার দিকে আলাউদ্দিনের নির্দেশে ড্রাইভার রহিম আলাউদ্দিনের নোয়া মাইক্রোবাসটি চালিয়ে লাশ ফেলে দেওয়ার জন্য খিলক্ষেত উত্তরপাড়ায় আহসানের বাসায় যান।

আহসান ও তামিম বিছানা, মশারি, বেডশিট ও পলিথিনে মোড়ানো মেহেদীর লাশটি মাইক্রোবাসে উঠিয়ে ড্রাইভার রহিমকে সায়েদাবাদে যেতে বলেন। পথে তামিম নেমে যান। আহসান মাইক্রোবাসে করে লাশটি নিয়ে হাতিরঝিল এলাকায় প্রবেশ করেন। হাতিরঝিল লেকের মেরুল-বাড্ডা প্রান্তে লোকজন বিহীন ও অন্ধকারচ্ছন্ন দেখে ড্রাইভার রহিম গাড়ি থামিয়ে দরজা খুলে দেন। আহসান লাশটি গাড়ি থেকে পানিতে ফেলে দেন।

গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের কাছে তিনটি পাসপোর্ট, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসার জন্য ব্যবহৃত মেহেদীর বাস টিকিট জব্দ করা হয়েছে। পাশাপাশি যে মাইক্রোবাসটি ব্যবহার করে মেহেদীর লাশ হাতিরঝিলে ফেলে দেওয়া হয়েছে, সেই মাইক্রোবাসটিও জব্দ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বিপিএম (বার), পিপিএম (বার) জানান- ‘এটি একটি ক্লু-লেস হত্যাকাণ্ড। ফিঙ্গার প্রিন্টের মাধ্যমে লাশের পরিচয় যাতে সনাক্ত করা না যায় সে জন্য হাতের আঙ্গুল বিকৃতকরণের পাশাপাশি মুখমন্ডলও বিকৃত করেন খুনিরা। যেখানে লাশ ফেলেছিলেন সেখান থেকে ৫০ মিটার দূরে পাওয়া একটি ছেড়া কাগজে লেখা একটি মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে লাশের পরিচয় সনাক্তকরণের পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডে জড়িত চারজন আসামিকে গ্রেপ্তার ও সব আলামত উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি আমরা। পুলিশি তদন্তের উৎকর্ষতার প্রমাণ এই মামলাটি।’

 

Comment here