রাজধানীর মালিবাগ বাজারে এসে তরিতরকারির দরদাম করছিলেন গৃহিণী লাভলী আক্তার। কিন্তু দামের সঙ্গে পেরে না উঠে শেষমেশ এক কেজি পেঁপে আর এক হালি কাঁচকলা কেনেন তিনি। ৩৫ টাকার পেঁপে মুলামুলি করে ৩০ টাকায় পেলেও কাঁচকলার হালি দোকানির দাম ৪০ টাকাতেই কিনতে হলো। খরচ হলো ৭০ টাকা। হাতের মুঠো থেকে দোকানিকে ১০০ টাকার একটি নোট দিতে দিতে বললেন, ‘যা দাম, তাতে পেঁপে আর কাঁচকলা ছাড়া অন্য সবজি কেনা সম্ভব নয়। সবজির বাজারেও এখন ৫০০ টাকার নোট নিয়ে আসতে হবে।’
গতকাল বাজার ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ সবজির কেজি ৭০ থেকে ৮০ টাকার মধ্যে। বেগুন, করলা, বরবটির মতো কয়েক পদের দাম ১০০ টাকায় পৌঁছেছে। একেকটি লাউ কিনতে লাগছে ৮০ টাকা। কাঁচামরিচের কেজি নতুন করে বেড়ে হয়েছে ২০০ টাকা।
মালিবাগ বাজারের সবজি বিক্রেতা মো. মোকাদ্দেস বলেন, ‘সাধারণত বছরের এ সময়টায় সবজির দাম বাড়তি থাকে। তবে এবার অনেক বেশি। কয়েকদিন ধরেই দাম বাড়ছে।’
মালিবাগ, রায়েরবাগ, কদমতলী এলাকাসহ বিভিন্ন কাঁচাবাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গতকাল প্রতি কেজি বেগুন (প্রকার ভেদে) ৯০ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। করলা ও বরবটির কেজি ১০০ টাকা, পটোল ও চিচিঙ্গা ৮০ টাকা, ঢেঁড়স ৭০ টাকা এবং মুলা ৭০ থেকে ৭৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। শিমের কেজি ১৮০ থেকে ২০০ টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কৃষকের হাত থেকে অনেক কম দামে বিক্রি হলেও রাজধানীর খুচরা বাজারে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সবজির দাম অতিরিক্ত বাড়ছে। দেখা গেছে, যত হাত বদল হয়, ততই দাম বাড়ে। এমনও দেখা গেছে, একই বাজার থেকে কিনে সেই বাজারেই বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাবনার ঈশ্বরদীর উপজেলার মুলাডুলি সবজির আড়তে যে গোল বেগুন ৬৫ থেকে ৭২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, রাজধানীর খুচরা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকা পর্যন্ত। অর্থাৎ বেগুনের ক্ষেত্রে দাম দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। অথচ কৃষক এ বেগুন ৬৫ টাকাতেও বিক্রি করেছেন। মূলত কৃষকের
হাত থেকে ফড়িয়া, ফড়িয়া থেকে স্থানীয় আড়তদার, এরপর ঢাকার বেপারি ও পাইকারি বাজার হয়ে খুচরায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রতিটি ধাপে অতিরিক্ত দাম বাড়ানো হচ্ছে।
পাবনা ও বগুড়া জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব অঞ্চলের কৃষকরা সম্প্রতি প্রতি কেজি করলা, বরবটি ও বেগুন প্রকার ভেদে ৬০ থেকে ৭০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। এ ছাড়া পটোল ৪০ থেকে ৫০ টাকা, চিচিঙ্গা ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, ঢেঁড়স ৩০ থেকে ৪৫ টাকা, মুলা ৪৫ থেকে ৫০ টাকা, শিম ১০০ থেকে ১১০ টাকা এবং কাঁচামরিচ ১১৫ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন। আর প্রতি পিস লাউ বিক্রি করে দাম পেয়েছেন ৪০ থেকে ৪২ টাকা।
কৃষকের কাছ থেকে এই দামে কিনে ফড়িয়ারা এবং স্থানীয় আড়তদাররা হাটে বিক্রি করছেন। তারা বেগুন ৭২ থেকে ৭৫ টাকা, করলা ৭৫ থেকে ৭৬ টাকা , বরবটি ৭৮ থেকে ৮০ টাকা, পটোল ৫২ থেকে ৫৭ টাকা, চিচিঙ্গা ৪২ থেকে ৪৫ টাকা, ঢেঁড়স ৪৫ থেকে ৫২ টাকা, মুলা ৫২ থেকে ৬০ টাকা, শিম ১২০ থেকে ১২৭ টাকা, কাঁচামরিচ ১২২ থেকে ১৩০ টাকা বিক্রি করছেন। লাউ বিক্রি করছেন ৪৫ থেকে ৪৭ টাকা।
পরিবহনসহ অন্যান্য খরচের পর এগুলো রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও শ্যামবাজার এলাকার পাইকারি বাজারে গতকাল বিক্রি হয়- বেগুন ৮০ থেকে ১৩০ টাকা, করলা ৯০ টাকা, বরবটি ৮৫ থেকে ৯০ টাকা, পটোল ৬৫ থেকে ৭০ টাকা, চিচিঙ্গা ৭০ টাকা, ঢেঁড়স ৬০ থেকে ৬২ টাকা, মুলা ৬২ থেকে ৬৫ টাকা, শিম ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা, কাঁচামরিচ ১৪৫ থেকে ১৭০ টাকা এবং এবং লাউ ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। খুচরায় গিয়ে এ দাম আরও বাড়ছে।
স্থানীয় ফড়িয়াদের দাবি, তারা দাম বাড়াচ্ছেন না। ঢাকায় গিয়ে দাম বেশি বাড়ছে। আর ঢাকার পাইকাররা বলছেন, পরিবহন খরচ বেশি হওয়ায় দাম বাড়ছে। স্থানীয় হাটেও আমদানি কম হওয়ায় আড়তদার ও ফড়িয়ারা দাম বেশি রাখছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর এক পাইকারি বিক্রেতা জানান, স্থানীয় হাটে এমনও হয় যে এক ফড়িয়া আরেক ফড়িয়ার কাছ থেকে কিনে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। আবার ঢাকায় এসেও একই ঘটনা ঘটছে। একই বাজারে এক বেপারির কাছ থেকে কিনে আরেক বেপারির দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন। অর্থাৎ হাত বদলের মারপ্যাঁচে সবজির দাম বাড়ছে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন মনে করেন, ‘সবজির বাজারে হাত বদলের সংখ্যা অনেক। আর প্রতিবার হাত বদলে দাম অতিরিক্ত বাড়িয়ে দেয় ব্যবসায়ীরা।’ আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘মধ্যস্বত্বভোগীরা অতিরিক্ত মুনাফা করে নিচ্ছে। কিন্তু কৃষক তো কম দামেই বিক্রি করেছে। এতে একদিকে কৃষক যেমন ঠকছেন, তেমন বাজারে অতিরিক্ত দামে কিনে ভোক্তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সবজির বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের এই দৌড়াত্ম্য না ঠেকালে দাম নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন।’
সবজির সরবরাহ কম হওয়ায় বাজার চড়া বলে মনে করেন পাবনার মুলাডুলি সবজির আড়তদাররা। তারা বলছেন, বর্তমানে এমনিতেই সবজির আমদানি কম। প্রতিদিন ঢাকার উদ্দেশে ১৫ থেকে ২০ ট্রাক সবজি যাচ্ছে। আমদানি বাড়লে ৫০ থেকে ৬০ ট্রাক সবজি যাবে। তখন দাম কিছুটা কমে আসবে।
বেপারি ও আড়তদাররা বলছেন, পরিবহন খরচ আগের চেয়ে বেড়েছে, যার প্রভাব দামেও পড়েছে। পাবনা থেকে ঢাকায় সবজি আনতে ট্রাকপ্রতি ভাড়া গুনতে হয় ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। আগে ছিল ১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকা। অপরদিকে বগুড়া থেকে ঢাকায় সবজি আনতে মিনি ট্রাকে ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা খরচ পড়ে যায়। ডিজেলের দাম বাড়ার আগে এ খরচ সাত হাজার টাকার আশপাশে ছিল। অপরদিকে বড় ট্রাকগুলোর ক্ষেত্রে খরচ আরও বেশি। বর্তমানে এ খরচ ১৮ থেকে ২১ হাজার টাকা।
হাত বদলে দামের চিত্র (প্রতি কেজি টাকার হিসাবে)
পণ্য কৃষক পর্যায়ে মূল্য ফড়িয়াদের ঢাকার আড়তে বিক্রি পাইকারি পর্যায়ে রাজধানীতে খুচরা মূল্য
বেগুন ৬০-৭০ ৭২-৭৫ ৮০-১৩০ ৯০-১৪০
করলা ৬০-৭০ ৭৫-৭৬ ৯০ ১০০
বরবটি ৬০-৭০ ৭৮-৮০ ৮৫-৯০ ১০০
পটোল ৪০-৫০ ৫২-৫৭ ৬৫-৭০ ৮০
ঢেঁড়স ৩০-৪৫ ৪৫-৫২ ৬০-৬২ ৭০
মুলা ৪৫-৫০ ৫২-৬০ ৬২-৬৫ ৭০-৮০
শিম ১০০-১১০ ১২০-১২৭ ১৫০-১৬০ ১৮০-২০০
কাঁচামরিচ ১৫-১২০ ১২২-১৩০ ১৪৫-১৭০ ১৬০-২০০
Comment here