বিকাশের চুরি, দেখার কেউ নেই? - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

বিকাশের চুরি, দেখার কেউ নেই?

জাকির হোসেন তমাল : দেশে ত্রাণ চুরি নিয়ে এখন হুলুস্থুল অবস্থা। এই কঠিন সংকটের সময়ে চাল চোরদের নিয়ে ব্যাপক সোরগোল চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এমন পরিস্থিতিতেও যারা চুরি করছে, তাদের নিয়ে অনেক কথাবলা হচ্ছে। অনেকে বলছেন, ‘ত্রাণ চোররা মারা যাবে না? এদের করোনাভাইরাসের ভয় নাই?’ কিন্তু দেশে কি শুধুই ত্রাণ চোররাই আছে, অন্য কেউ নেই? তাদের কি সঠিকভাবে মনিটর করা হচ্ছে?

এই যেমন মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান বিকাশ। দেশের এই কঠিন সময়ে সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে গ্রাহকের পকেট মারছে। গরিবের সঙ্গে প্রতারণা করছে। এই খবর গতকাল বুধবার গণমাধ্যমে প্রকাশও হয়েছে। কিন্তু তাদের নিয়ে খুব একটা হৈচৈ দেখি না।

বিকাশ অ্যাপস চালুর সময় অনেক ধরনের কৌশলী অফার দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। তার মধ্যে অন্যতম হলো, ব্যক্তিগত নম্বর থেকে অন্য ব্যক্তিগত নম্বরে টাকা পাঠালে কোনো ধরনের চার্জ নিতো নেওয়া হতো না। আবার ক্যাশআউট করলে লাগত ১৫ টাকা। এই সংকটের সময়ে সেটা আরও কমানোর কথা ছিল, কিন্তু সেটা আরওনেড়েছে। বিষয়টি বুঝতে পারলাম গত ১৯ এপ্রিল। ওই দিন আমার ব্যক্তিগত নম্বর থেকে আরেটি ব্যক্তিগত নম্বরে এক হাজার টাকা পাঠাতে গিয়ে দেখলাম, আমার ৫ টাকা বাড়তি কেটে নিয়েছে। অবাক না হয়ে পারলাম না। নিশ্চয় সবারই তাই কাটছে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, ঘটনা সত্যি। দেশের অর্থনৈতিক এই সংকটে এভাবে টাকাটা না কাটলেই কি হতো না? করোনার সময় বাইরে যাওয়া যেখানে ঝুঁকিপূর্ণ, মানুষ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের দিকে ঝুকছে, তাহলে দেশের প্রতিষ্ঠান হয়ে এভাবেগ্রাহকদের ধোকা দেওয়ার মানে কী?

করোনাভাইরাস (কোভিডি-১৯) সংক্রমণে বিশ্বের অর্থনীতি এখন বিপর্যস্ত। সেই সঙ্গে দেশের অর্থনীতিও হুমকির মুখে। এই পরিস্থিতিতে অন্য প্রতিষ্ঠানের মতো ব্যাংকগুলো ক্ষতির সম্মুখীন। স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে ব্যাংকের বেশিরভাগ শাখা বন্ধ বা কিছু শাখা সীমিত আকারে খোলা। এমন পরিস্থিতিতে ছোট আকারের লেনদেন করতে অনেকে মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করছেন। নির্দিষ্ট পরিমাণ লেনদেনে কোনো ধরনের চার্জ আদায় না করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশনা দিলেও তা অমান্য করে পাবলিকের টাকা চুরি করছে বিকাশ।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, দেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দিতে এখন পর্যন্ত লাইসেন্স নিয়েছে অন্তত ১৫টি প্রতিষ্ঠান। গত ১৯ মার্চ প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, দিনে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত ক্যাশ আউট করলে গ্রাহকের থেকে কোনো চার্জ নেওয়া যাবে না। একই সঙ্গে নিত্যপণ্য ও ওষুধ ক্রয়ের ক্ষেত্রে সেন্ড মানি ফ্রি করার কথাও বলা হয়। কিন্তু বিকাশ এটি মানেনি। দেশের এই কঠিন সংকটে প্রতিষ্ঠানটি কৌশলে পাবলিকের পকেট কাটছে।

গত ৩০ মার্চের খবর অনুযায়ী, লকডাউনের এই সময়ে দেশের বেশির ভাগ বিকাশ এজেন্ট বন্ধ। এরপরও বিকাশে দৈনিক ৫৭ লাখ লেনদেন হচ্ছে, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৪০০ কোটি। একবার ভাবুন তো, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মানলে, এই টাকার একটা অংশ গ্রাহকরা পেত না। সেই পরিমাণটা যতই হোক না কেন, ৫৭ হাজার লেনদেনে অনেকেই দিনে একবার এক হাজার টাকা ক্যাশ আউট করেছেন। তাহলে তাদের ১৮ টাকা ৫০ পয়সা বা তারও বেশি টাকা তো বিকাশ চুরি করেছে। সেই টাকা কি তারা ফেরত দেবে?

চুরির পক্ষে বিকাশের যুক্তি ও কর্তৃপক্ষের বক্তব্য

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা কেন মানা হচ্ছে না, এর উত্তরে বিকাশের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা শামসুদ্দিন হায়দার ডালিমআমাদের সময়কে বলেন, ‘বাকি যে অপারেটরটা আছে, তারাও কিন্তু একই কাজটা করছেন। যেটা হচ্ছে, এক হাজার টাকা ক্যাশ আডাউট ফ্রি, মাসে একবার।’ যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এমন কোনো দির্দেশনা দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, দিনে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত ক্যাশ আউট করলে গ্রাহকের থেকে কোনো চার্জ নেওয়া যাবে না। এই নির্দেশনার তোয়াক্কা করছে না বিকাশ। উল্টো তারা ভিন্ন যুক্তি দিচ্ছে। যার সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার কোনো যোগসূত্র নেই।

বিকাশের পক্ষে সাফাই গেয়ে শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকে জানিয়েই মাসে একবার এক হাজার টাকা ক্যাশ আউট ফ্রি করা হয়েছে।’  এ সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো লিখিত ডকুমেন্ট আপনাদের আছে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে বিকাশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘না, এরকম লিখিত আকারে কিছু নেই। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের নলেজে রেখে এমনটা করা হচ্ছে।’ দিনে ৫০০ টাকা পর্যন্ত সেন্ডমানি ফ্রি করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

বিকাশের এই কর্মকর্তার বক্তব্যে যে ফাঁক আছে, সেটা স্পষ্ট হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তার বক্তব্যে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলছেন, ‘ক্যাশ আউট চার্জ মাসে এক বার ফ্রি করার কোনো নির্দেশ দেওয়া হয়নি। তারা আমাদের জানিয়েছেন, ক্যাশ আউট ফ্রিনা করে ক্যাশব্যাক দিচ্ছেন। সেই হিসেবে তারা রিপোর্ট করছেন। তবে কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বলে এমন ক্যাশব্যাক অফারের কথা জানা যায়নি।’

কোন প্রতিষ্ঠান কত টাকা কাটে

দেশের স্বল্পআয় করামানুষরাবেশিরভাগ সময় মোবাইলব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা লেনদেন করে থাকেন। সেটাই তাকের কাছে এখন জনপ্রিয়। কিন্তুএব্যাংকিংয়েসেবানেওয়ারখরচঅনেকবেশি। গ্রাহকের টাকা টাকার ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছে বিকাশ। ক্যাশ আউটে প্রতি হাজারে বিকাশ যেখানে ১৮ টাকা ৫০ পয়সা বা তারও বেশি নিচ্ছে, সেখানে নগদেনিচ্ছে মাত্র সাড়ে১৪টাকা। আর ক্যাশইনে কোনো চার্জ না থাকলেও বিকাশ সেখানে চার্জ ধরছে। এভাবে অনেক ক্ষেত্রে তারা গ্রাহকের টাকা মারছে।

অন্যদিকে, ব্যাংকগুলোর অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলতে কোনো খরচ হয় না, এমন কি জমা দিতেও না। কিন্তু মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলতে প্রতি হাজার ১৮ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ২০ টাকা প্রয়োজন পড়ে। তবে অনলাইন ব্যাংকিংয়ে কিছুটা খরচ আছে। ঢাকা থেকে গ্রামের শাখায় টাকা জমা করতে গেলে ১ লাখ টাকায় খরচ হয় ২০ থেকে ৩০ টাকা। সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টধারী ওই টাকা তুলতে গেলে কোনো খরচ গুণতে হয় না। কিন্তু মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মধ্যে গ্রাহকের থেকে খরচ নেওয়া হয়। তুলতে ও পাঠাতে।

শুধু ত্রাণ চুরিই দোষ?

বিকাশের এই বিস্তর চুরির কি কোনো জবাবদিহিতা আছে। এই সংকটের সময়ে দেশের দরিদ্র মানুষের সঙ্গে এমন প্রতারণার কোনো উত্তর আছে? তাদের এই চুরির জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে কি? হয়তো এখনো হয়নি। সেটা আদৌ হবে কি না, সেটাও আমাদের জানা নেই। তবে এই চুরি বন্ধ হওয়া দরকার।

দেশে কিছু দিন ধরেই ত্রাণ চুরির তালিকায় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে চুনোপুটি নেতাদের নাম উঠে এসেছে। তাদের অনেকে আবার ক্ষমতাসীন দলের পদধারী নেতা। অবশ্য ত্রাণ চুরি ধরা খাওয়ার পর ওসব নেতা এখন পদ হারিয়েছেন। সেই পদের জোড়েই যে ওই নেতারা এতদিন দম্ভ করে চুরি করতেন, এটা বোঝা গেল তাদের পদ কেড়ে নেওয়ার পর। এসব নেতারা শুধু পদ হারাননি, কেউ কেউ ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জেলে গেছেন। আবার অনেকের নামে মামলা হয়েছে। তাদের অনেকে এখন জেলে গেছেন।

এসব ছিঁচকে চোরদের নিয়ে এত আলোচনার পেছনে একটাই কারণ, তারা সরকারি কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত বা দলের নেতা। ওই চোরদের সমালোচনার মাধ্যমে মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলতে চায়, নিজেদের রাগ কমায়। কিন্তু দেশে আরও অনেক ধরনের চুরি হয়, গরিবের টাক যে বিকাশ নিজের পটেকে রাখছে, সেটা নিয়ে বেশি উচ্চবাচ্চ কেউ করছে না। এর কারণ বিশ্লেষণ করার সময় এসেছে।

জাকির হোসেন তমাল : সাংবাদিক

Comment here