নিজস্ব প্রতিবেদক : অ্যাজমাজনিত শ্বাসকষ্ট নিয়ে ছয়টি বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরেও ভর্তি হতে পারেননি ৬৩ বছর বয়সী এক নারী। পরে সরকারি হাসপাতালে যাওয়ার আগে অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যান তিনি।
নিহতের পরিবারের ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি জানান, সিলেট নগরীর কাজিরবাজার মোগলটুলা এলাকার বাসিন্দা ওই নারী দীর্ঘদিন ধরে অ্যাজমায় ভুগছিলেন। গত রোববার রাতে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় বিনা চিকিৎসায় তিনি মারা যান বলে
নিজের ও মৃত নারীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি বলেন, ‘ওই নারীর অসুস্থতার খবর পেয়ে আমি দ্রুত তাদের বাসায় যাই। রাত সোয়া ১২টার দিকে তাকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে আল হারামাইন হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু তারা বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে তাকে ভর্তি করেনি।’
তিনি বলেন, ‘তারপর পর্যায়ক্রমে ওয়েসিস হাসপাতাল, নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট মা ও শিশু হাসপাতাল, পার্ক ভিউ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে আমাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। রাত সোয়া দুইটার দিকে তাকে নিয়ে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছালে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা জানান যে তিনি অ্যাম্বুলেন্সেই মারা গিয়েছেন।’
তিনি জানান, এতগুলো হাসপাতালের মধ্যে মা ও শিশু হাসপাতাল একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে সহযোগিতা করেছে এবং রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকরা দ্রুত এক্স-রে করিয়ে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিলেও সবাই বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে রোগী ভর্তি করেনি।
ওই ব্যক্তি আরও জানান, মৃত নারীর জানাজা শেষে গতকাল সোমবার দুপুরে তাদের গ্রামের বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার কাসাদিঘীরপার গ্রামে দাফন সম্পন্ন করা হয়।
এই অভিযোগের বিষয়ে আল হারামাইন হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. নাহিয়ান চৌধুরী বলেন, ‘দুই বছর আগে শুরু হলেও এখনো হাসপাতালের পূর্ণ কার্যক্রম শুরু হয়নি এবং মাত্র ৮০টি বেড নিয়ে আমরা চিকিৎসা সেবা দিচ্ছি। সে রাতে আমাদের সব বেডে রোগী ছিলেন এবং আইসিইউ ও সিসিইউতেও কোনো বেড খালি না থাকায় আমরা তাকে ভর্তি করতে পারিনি। ইচ্ছাকৃতভাবে না, বরং বাধ্য হয়েই সে রাতে ওই নারীসহ পাঁচজন রোগীকে ফিরিয়ে দিতে হয়েছে।’
এদিকে ওয়েসিস হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। হাসপাতালের সহকারী ব্যবস্থাপক মনসুর আলম বলেন, ‘কোভিড-১৯ এর উপসর্গ থাকা রোগীদের জন্য আমাদের হাসপাতালে তিন বেডের ফ্লু কর্নার আছে। সে রাতে কাউকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই। যদি কেউ এরকম অভিযোগ করেন, তবে তা মিথ্যা।’
নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছি। এ কারণে হাসপাতালের সব সাধারণ রোগীকে একটি ভবনে স্থানান্তর করা হচ্ছে এবং অন্য ভবনটিকে কোভিড-১৯ এর জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। এরকম সময়ে একজন কোভিড সাসপেক্টেড রোগী আসায় তাকে ভর্তি করা যায়নি, তবে আমরা আজ মঙ্গলবার থেকে সব ধরণের রোগী ভর্তি করবো।’
সিলেট মা ও শিশু হাসপাতালের ব্যবস্থাপক মুর্শেদুর রহমান বলেন, ‘ওই নারীর যে অসুস্থতা ছিল, তার চিকিৎসার ব্যবস্থা আমাদের কাছে না থাকায় আমরা তাকে ভর্তি করতে পারিনি। তবে তার অ্যাম্বুলেন্সে অক্সিজেন শেষ হয়ে যাচ্ছিল, তাই আমরা একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে সহযোগিতা করেছি।’
পার্ক ভিউ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. তন্ময় ভট্টাচার্য বলেন, ‘ওই রোগী যখন আমাদের কাছে আসেন, তখন আমাদের হাসপাতালের দুটি ভেন্টিলেটরই অন্য রোগীদের জন্য ব্যবহার হচ্ছিল। সে সময় উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৬০ ভাগের নিচে নেমে আসে এবং আইসিইউতে বেড থাকলেও ভেন্টিলেটর ছাড়া এ অবস্থায় চিকিৎসা সম্ভব না ভেবে আমরা রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজে যেতে পরামর্শ দেই।’
জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. তারেক আজাদ বলেন, ‘ওই রোগী এখানে আসার পর আমাদের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ও আইসিইউতে কর্তব্যরত চিকিৎসক উনাকে দেখেন। পরে আইসিইউ কনসালটেন্টের পরামর্শে উনার এক্সরেও করা হয়। এক্সরের রিপোর্ট দেখে কোভিড-১৯ সন্দেহভাজন রোগী মনে হওয়ায় এবং রোগীর শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ থাকায় তাদেরকে কোভিড চিকিৎসায় বিশেষায়িত সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে ভর্তি করার জন্য বলা হয়।’
এ বিষয়ে সিলেট বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান বলেন, ‘স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ঘোষিত এ নির্দেশনা অনুযায়ী জেলা সিভিল সার্জন একবার এবং বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক কার্যালয় থেকে একবার সব হাসপাতালকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। তারপরও রোগী ভর্তি না করে ফিরিয়ে দেওয়া খুবই দুঃখজনক।’
তিনি বলেন, ‘ওই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তারা যদি আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের কাছে অভিযোগ দিতেন, তাহলে আমরা শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারতাম। তবে আমরা বিষয়টি উল্লেখ করে সব হাসপাতালকে সতর্ক করে চিঠি পাঠাচ্ছি যাতে এরকম ঘটনা আর না ঘটে।’
সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. হিমাংশু লাল রায় বলেন, ‘কোনো রোগী কোথায় ভর্তি হবেন, এটা তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তবে আমাদের হাসপাতাল সর্বোচ্চ চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে সবসময়ই খোলা রয়েছে।’
Comment here