সুমন মজুমদার : সময়মতো পরীক্ষা করা হলে মারাত্মক ছোঁয়াচে নোবেল করোনা ভাইরাস আক্রান্তদের চিকিৎসা অনেক সহজ হয়ে যায়। পাশাপাশি তাকে সময়মতো সঙ্গবিচ্ছিন্ন করাও সহজ হয়। চীনে গত ডিসেম্বরে এই নতুন প্রাণঘাতী ভাইরাসটির উৎপত্তি হলেও তখন দেশটি ব্যাপকহারে নাগরিকদের পরীক্ষা না করায় পরবর্তীতে তাদের এ জন্য চরম মূল্য দিতে হয়। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মারাত্মক ছোঁয়াচে এই রোগটি গোটা চীনে ছড়িয়ে গিয়ে ব্যাপক প্রাণহানি হয়।
সে সময় চীনের পার্শ্ববর্তী দেশ হয়েও প্রাথমিক স্তরে ভ্রমণের বিধিনিষেধ, ব্যাপক পরীক্ষা, করোনা আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের শনাক্ত করা এবং কঠোর কোয়ারেন্টিন নীতির কারণে মহামারী ঠেকিয়ে দিয়ে এখন বিশ্বের কাছে রোল মডেল তাইওয়ান। কিন্তু ইউরোপ আমেরিকা ও এশিয়ার দেশগুলো এ থেকে তখন শিক্ষা না নেওয়ায় আজ করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী।
ইউরোপ-আমেরিকায় এই রোগে চলছে মৃত্যুর মিছিল। আর আক্রান্তের সংখ্যা হু হু করে বাড়ার আশঙ্কায় রয়েছে এশিয়ার দেশগুলো। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিটি দেশই করোনা পরীক্ষা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। তাইওয়ান কীভাবে করোনা মোকাবিলায় সফল হলো- এ প্রসঙ্গে স্ট্যানফোর্ড হেলথ পলিসির বিশ্লেষণে বলা হয়, ২ কোটি ১০ লাখ জনসংখ্যার দেশটিকে করোনার জন্য দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল বলে উল্লেখ করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা।
কিন্তু গত জানুয়ারিতে সেখানে করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পরই এ নিয়ে সতর্ক অবস্থান নিয়েছিল তাইওয়ানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এর পরই ন্যাশনাল হেলথ কমান্ড সেন্টার স্থাপন করে দেশজুড়ে জনগণের মধ্যে ব্যাপক পরীক্ষা চালায় তাইওয়ান সরকার। ২০ জানুয়ারির মধ্যেই সেন্টার এডিডেমিক কমান্ড সেন্টার (সিইসিসি) সক্রিয় করে সম্পন্ন করা হয় রোগী শনাক্তকরণ, অর্থ বণ্টন, সচেতনতা থেকে শুরু করে ১২৪টি কার্যক্রম। তারই ধারাবাহিকতায় এখন গতকাল পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৩৩৯ এবং মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র ৫ জনে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে দেশটি।
তাইওয়ানের মতোই করোনা নিয়ন্ত্রণে আরেক মডেল চীনের পার্শ্ববর্তী দেশ দক্ষিণ কোরিয়া। ২০ জানুয়ারি দেশটিতে প্রথম সন্দেহভাজন রোগী দেখা যায়। পরবর্তীতে চীনের সঙ্গে সেখানেও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। কিন্তু এর পরেই নড়েচড়ে বসে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার। এখন তিন সপ্তাহ ধরে সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা ১০০ বা তার নিচে রয়েছে।
জানা যায়, চীন ভাইরাসটিকে শনাক্ত করার কিট তৈরির তিন দিন আগে ৪ জানুয়ারি দক্ষিণ কোরিয়ার বিশেষজ্ঞরা করোনা পরীক্ষার পদ্ধতি আবিষ্কার করে ফেলেন। এর পর আগ্রাসী ও টেকসই পরীক্ষা পদ্ধতি ব্যবহার করে দক্ষিণ কোরিয়া দ্রুত দেশে করোনার প্রাদুর্ভাবের গতি কমিয়ে আনে। গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত অন্তত আড়াই লাখ মানুষের করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে দেশটির শতাধিক হাসপাতাল-ক্লিনিকের পাশাপাশি করোনা ভাইরাস পরীক্ষায় প্রায় অর্ধশত ভ্রাম্যমাণ ল্যাবরেটরিও কাজ করছে।
সিনহুয়ার তথ্য অনুযায়ী, করোনা গোটা চীনে ছড়িয়ে পড়ার পর দেশটির সরকার জনগণের মধ্যে ব্যাপক পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়। প্রতিটি রাজ্যে ইউনিট ভাগ করে এলাকায় এলাকায় চালানো হয় পরীক্ষা। এর মধ্যে কেউ করোনা আক্রান্ত বলে শনাক্ত হলে দ্রুততার সঙ্গে তাকে আইসোলেশনে নেওয়া হয়। সেই সঙ্গে চলেছে ব্যাপক সচেতনতা কার্যক্রম। এরই ধারাবাহিকতায় সেখানেও কমেছে রোগী।
ইউরোপে এই মহামারী এখন ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করায় সেখানকার দেশগুলোও নাগরিকদের মধ্যে করোনা পরীক্ষার ব্যাপকতা বাড়িয়েছে। জার্মানি ঘোষণা দিয়েছে তারা দিনে অন্তত ৫০ হাজার মানুষের পরীক্ষা করবে। দেশটির জনস্বাস্থ্য ও সংক্রামক ব্যাধি গবেষণা বিষয়ক সংস্থার প্রতিষ্ঠান দ্য রবার্ট কোচ ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, তারা এখন পর্যন্ত গোটা জার্মানিতে ৯ লাখ ১৮ হাজারের বেশি মানুষের করোনা পরীক্ষা করেছে।
ব্রিটিশ সরকারও জানিয়েছে, তারা দিনে ২৫ হাজারের বেশি মানুষের করোনা পরীক্ষা লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। যদিও দেশটিতে একদিনে করোনা পরীক্ষার সক্ষমতা রয়েছে ১২ হাজার ৭৫০ জনের। তবে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে এই সংখ্যা অনেক বাড়বে বলে দাবি করেছেন ব্রিটিশ গৃহায়ণমন্ত্রী রবার্ট জেনরিক। সম্ভাব্য রোগীর পাশাপাশি মেডিক্যালকর্মীদেরও করোনা পরীক্ষা শুরু করেছে ব্রিটেন। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, দেশটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে করোনা পরীক্ষা করা হচ্ছে না।
করোনার প্রকোপে বিপর্যস্ত পশ্চিম ইউরোপের দেশ ইতালি ও স্পেনও সংকটের মধ্যেই করোনা পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ব্যাপক পরীক্ষা কার্যক্রম ও রোগীকে সতর্কতার সঙ্গে আইসোলেশনে রাখার কারণে উত্তর ইতালির ভো শহরে সংক্রমণের হার শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
যদিও এ ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র ব্যাতিক্রম যুক্তরাষ্ট্র। আক্রান্ত ও মৃত্যুর দিক থেকে দেশটি শীর্ষে উঠে এলেও সেখানে এখনো ব্যাপক হারে করোনা পরীক্ষা করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ মার্কিন নাগরিকদের। দেশটির চিকিৎসকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে করোনা ভাইরাস পরীক্ষার কিটের সংকট রয়েছে। অথচ মহামারী ঠেকাতে আরও কিট দরকার। তবে সরকারি সচেতনতা কার্যক্রম তেমন জোরদার না হওয়ায় সামাণ্য সর্দিজ্বরেই মানুষ করোনা পরীক্ষার জন্য ভিড় করছে। তবে কিট সংকটের কারণে চিকিৎসকরা এখনো শুধু যাদের ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন তাদেরই করোনা পরীক্ষা করছেন। তবে এমন পরিস্থিতি বেশিদিন চলতে পারে না বলেও স্বীকার করেছেন তারা।
Comment here