একতলা থেকে লাফিয়ে প্রাণে বাঁচলো শিশুরা - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
আন্তর্জাতিক

একতলা থেকে লাফিয়ে প্রাণে বাঁচলো শিশুরা

অনলাইন ডেস্ক : বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনকে (সিএএ) কেন্দ্র করে রক্তস্নাত ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় এখন শ্মশানের নিস্তব্ধতা। হিংসায় পুড়ে ছাই ঘরবাড়ি। রক্ষা পায়নি কোনো কিছুই। শুধু প্রাণটা কোনোমতে বেঁচে গেছে। তাও আবার একতলা থেকে লাফ দিয়ে। গত সোমবারের উন্মত্ত জনতার হামলার সময় এমন ঘটনা ঘটেছে দিল্লির পাশে যমুনা বিহার অঞ্চলে।

ভারতের সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি ও আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যমুনা বিহার অঞ্চলের ৩৩ বছর বয়সী প্রীতি গর্গের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। সেই দিনগুলোর কথা তুলতেই তার মনে পড়ে যাচ্ছে, দাঙ্গাবাজরা কীভাবে তার বাড়িতে আগুন দিয়েছে? তার ৫ ও ৯ বছরের দুই ছেলে জীবন বাঁচাতে একতলা থেকে ঝাঁপ দেয়।

প্রীতি বলেন, ‘সোমবার বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে তাণ্ডব চলে। পাথর ছোঁড়া দিয়ে শুরু হয়েছিল, পরে ওরা আগুন লাগিয়ে দেয়। তারা আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র ২০০ মিটার দূরে একটি পেট্রল পাম্প জ্বালিয়ে দেয়। ওরা বাড়ির সামনের অংশেও আগুন ধরিয়ে দেয়, নিচতলা সেই সময় খালি, আগুনের শিখা দাউ দাউ করে উপরে উঠতে থাকে। আমার ছেলেরা ও আমি একতলায় ছিলাম, সঙ্গে ছিল আমার স্বামী এবং আমার শাশুড়ি। আমরা আমাদের বাচ্চাদের প্রথমে বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নিই।’

‘আমরা বারান্দা থেকে বাচ্চাদের হাত ধরে ওদের নিচে নামাই তারপর ওদের বলি নিচে ‘লাফ দে’! আমার জীবনের অন্যতম ভয়ানক মুহূর্ত ছিল সেটা। বাচ্চাদের বাঁচিয়ে নেওয়ার পরে আমরা বাকিরা ছাদে চলে যাই, সেখান থেকে প্রতিবেশীর ছাদে উঠি,’ বলেন প্রীতি।

প্রীতির বাড়ির নিচতলা পুড়ে ছাই। তার শাশুড়ি সন্তোষ বলেন, ‘যখনই আমি বারান্দায় যাচ্ছি, মনে পড়ছে আমার নাতি-নাতনিরা আগুন থেকে বাঁচতে একতলা থেকে ঝাঁপ দিচ্ছে….সব মনে পড়ে যাচ্ছে।’

এদিকে, শিব বিহারে ৩৫ বছরের পুরোনো ভিটেটা চিনতেই পারছেন না বিলকিস বানু নামে এক বৃদ্ধা। গত সোমবারের উন্মত্ত জনতার হামলার কথা মনে করে এখনো ডুকরে কেঁদে উঠছেন তিনি। উত্তর-পূর্ব দিল্লির শিব বিহারের বাসিন্দা ৬০ বছরের এই বৃদ্ধা।

সোমবার আক্রমণকারীরা যখন তেড়ে আসে সেই সময় বাড়ির ভেতরেই ছিলেন বিলকিস বানু। প্রায় ৩৫ বছর ধরে ওই বাড়িতেই থাকেন তিনি। পরিবারের একটি দোকান বাড়ির নিচেই ছিল। তবে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে সব শেষ।

বিলকিস বানু বলেন, ‘আগুনে সমস্ত কিছু জ্বলছিল, সমস্ত কিছু… আমি প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ে পালাতে যাই… তবে পড়ে গিয়েছিলাম। উন্মত্ত জনতা আমাকে ধরে ফেলেছিল। হামলাকারীরা সর্বত্র দৌড়ে বেড়াচ্ছিল, বাড়িঘর, দোকানপাটে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছিল। আমি হামাগুড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে পালাতে যাই। আমার বড় ছেলে মহাম্মদ ইউসুফ (৪২) আমাকে খুঁজে পায়, তারপর ভিড়ের বাইরে টেনে নিয়ে এসে একটি নিরাপদ স্থানে ছুটে পালায়।’

আগুনে দোতলা বাড়ি এবং দোকান ছাই হয়ে গেছে জানিয়ে এই বৃদ্ধা জানান, তিনি তার দুই ছেলে এবং পুত্রবধূদের সঙ্গে নিয়ে হামলার পরে পাশের এক মাজারে আশ্রয় নিয়েছেন।

নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (সিএএ) পক্ষে ও বিপক্ষে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে যে বিশাল দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে তাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হলো শিব বিহার! এই সহিংসতা ৪০ জনেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন এবং শতাধিক মানুষ এখনো আহত অবস্থায় হাসপাতালে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, উন্মত্ত জনতা এসে সব তছনছ করে দেয়, চোখের সামনে যা ছিল তাতেই আগুন লাগিয়ে দেয় তারা। কয়েকশো পরিবার এলাকা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়।

গত শনিবার বিলকিস বানু যখন এনডিটিভির সঙ্গে কথা বলেন, তখনো তার পরনে সোমবার তিনি যে পোশাক পরেছিলেন সেটিই। তার ছেলে ইউসুফ বলেন, ‘আমি এই যে শার্টটা পরে আছি… মিনিট খানেক আগে আমি প্রতিবেশীর কাছ থেকে ধার নিয়েছি।’

উল্লেখ্য, নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন বা সিএএ-র বিষয়ে হিংসার জন্য দিল্লি পুলিশ দেড়শোরও বেশি এফআইআর দায়ের করেছে। চার দিনের সংঘর্ষে ২৫০ জনেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত কিছু অংশে ধীরে ধীরে নিষেধাজ্ঞা তুলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা হচ্ছে।

Comment here