ইউসুফ আরেফিন : স্বাধীনতার পর দেশে ফিরেই দেশ গড়ার কাজে হাত দেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ বিনির্মাণের পাশাপাশি প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে মানুষের সেবা করার আহ্বান ছিল তার। ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার ছিলেন। তাঁর বহু বক্তৃতা-বিবৃতিতে সেসব উঠে এসেছে। কর্মচারীদের সতর্ক করে ১৯৭২ সালের ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক ভাষণে বলেছিলেন, সরকারি কর্মচারী ভাইয়েরা, আপনারা ঘুষ খাবেন না। আমার লোক আছে। আমি সব খবরই পাচ্ছি।
কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সেসব আহ্বান বাস্তবায়ন হওয়া নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ-দুর্নীতির শত শত অভিযোগ প্রকাশ হচ্ছে। গত বছরের ২৩ জুন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক প্রতিবেদনেও বলা হয়, সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়লেও দুর্নীতি কমেনি। অর্থাৎ স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও একটি দুর্নীতিমুক্ত ও জনবান্ধব প্রশাসন গড়ে ওঠেনি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভাষ্য, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের প্রশাসন নির্মাণের পথেই হাঁটছে সরকার।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন এ বিষয়ে আমাদের সময়কে বলেন, দুর্নীতি কমিয়ে একটি জনবান্ধব প্রশাসন নির্মাণে কাজ করছে বর্তমান সরকার। এ জন্য প্রশাসনকে শত ভাগ ডিজিটাইজ করার উদ্যোগ নিয়েছি। প্রশাসনের সব কাজ যদি ডিজিটাল হয়ে যায় তা হলে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুর্নীতি করার সুযোগ পাবেন না। আমরা প্রশাসন থেকে দুর্নীতি দূর করে জাতির পিতার স্বপ্নের দেশ গড়ব ইনশাআল্লাহ। তিনি আরও বলেন, যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তার নিজ দলের নেতাকর্মীদেরও ছাড় দিচ্ছেন না বলে দাবি করেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মো. মোজাম্মেল হক খান আমাদের সময়কে বলেন, সংবিধানের ২১ (২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, সব সময় জনগণের সেবা করার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য। কিন্তু সব সময় তা দেখা যায় না। সত্যিকারভাবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নে দেখা দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত সমাজ পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বেশ কয়েকবার চ্যম্পিয়নও হয়েছিল। বিশ^দরবারে আমাদের লজ্জা পেতে হয়েছিল। ২০০৮ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেন।
জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, প্রশাসনিক কাঠামোয় জনগণ এবং সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে নৈকট্য সৃষ্টির পূর্ণ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আমরা বাংলাদেশের মহকুমাগুলোকে জেলা পর্যায়ে উন্নীত করার পরিকল্পনা তৈরি করছি। শ্মশান বাংলাকে সোনার বাংলা করে গড়ে তুলতে চাই। সে বাংলায় আগামী দিনের মায়েরা হাসবে, শিশুরা খেলবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলব।
১৯৭২ সালের ২৬ জুন নোয়াখালীর মাইজদীকোটে এক জনসভায় কর্মচারীদের সতর্ক করে তিনি বলেন, খবরদার, গরিবের হক কেউ মেরে খাবা না। আমি গরিবের জন্য, গরিব আমার জন্য। ভাইয়েরা আমার, ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করো। না হলে ভালো হবে না। বঙ্গবন্ধু সব সময় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমালোচনাই করেননি, নানা সময় তাদের প্রশংসাও করেছেন।
১৯৭২ সালের ৯ মে রাজশাহী মাদ্রাসা ময়দানে ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, জালেমরা রাস্তাঘাট ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। চালের গুদাম ধ্বংস করে দিয়েছে। আমার সরকারি কর্মচারীদের গুলি করে হত্যা করেছে। নির্ভীক বাংলার সৈনিক, নির্ভীক মুজাহিদ আনসার, পুলিশ, সাবেক ইপিআর, নির্ভীক বাংলার ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী ও সরকারি কর্মচারীদের একাংশ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেই নমরুদের বিরুদ্ধে। সেই সংগ্রাম হয়েছিল চরম সংগ্রাম। বলেন, রক্ত দিয়েছে প্রত্যেকটি বাঙালি, এমনকি সরকারি কর্মচারীরাও রক্ত দিয়েছে এই স্বাধীনতা সংগ্রামে।
১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই প্রেসক্লাবে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের বার্ষিক অধিবেশনে শেখ মুজিব বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে অনেক সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধেই তো মিথ্যা কথা লেখা হয়েছে; কিন্তু কারও প্রতিবাদই খবরের কাগজে ছাপা হয়নি। এটা সাংবাদিকতার কোন নীতিমালায় আছে?
গণপরিষদে খসড়া শাসনতন্ত্র অনুমোদনে ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, আইনের চোখে সাড়ে সাত কোটি মানুষের যে অধিকার, সরকারি কর্মচারীদেরও সেই অধিকার। আজ যে কাজ করবে এবং লোকে তাকে কতটুকু ভালোবাসে তার ওপর নির্ভর করবে তার প্রমোশন। প্রমোশনের ব্যাপারে গরিব, অল্প বেতনভোগী কর্মচারীদেরও অধিকার থাকবে। গরিব কর্মচারীদের গায়ে কেউ হাত দিতে পারবে না। তবে সরকারি কর্মচারীদের মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে; তারা শাসক নন, সেবক। সরকারি কর্মচারীদের জণগণের সাথে মিশে যেতে হবে। তারা জনগণের খাদেম, সেবক, ভাই। তাদের এই মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আ.লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে দলীয় চেয়ারম্যান বঙ্গবন্ধু বলেন, ব্রিটিশ আমলের এই ঘুণে ধরা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সিস্টেম দিয়ে বাংলার মানুষের মঙ্গল হতে পারে না। ইট মাস্ট গো। সেই জন্য আমূল পরিবর্তন দরকার হয়ে পড়েছে। দ্যাট ইজ অলসো এ রেভোল্যুশন। নেশন মাস্ট বি ইউনাইটেড অ্যাগেইনস্ট করাপশন। পাবলিক ওপিনিয়ন মবিলাইজ না করলে শুধু আইন দিয়ে করাপশন বন্ধ করা যাবে না। তিনি আরও বলেন, সেকেন্ড রেভোল্যুশন (দ্বিতীয় বিপ্লব) যে করেছি আমি, চারটা প্রোগ্রাম দিয়েছি, এটাই শেষ নয়। শেষ কথা নয়, এটা হলো স্টেপ। ডেভেলপমেন্ট, মোর প্রোডাকশন, ফাইট অ্যাগেইনস্ট করাপশন, ন্যাশনাল ইউনিটি অ্যান্ড ফ্যামিলি প্ল্যানিং।
বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, উই মাস্ট মবিলাইজ দ্য পিপল অ্যাগেইনস্ট করাপশন। আমাদের সোশ্যালি বয়কট করতে হবে যে লোকটা ঘুষ খায়, তাকে। আমাদের আদর্শ হলো বাংলাদেশকে স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ইজ্জত সহকারে দুনিয়ায় বাঁচিয়ে রাখা, বাংলার দুঃখী মানুষকে পেট ভরে খাবার দিয়ে শোষণমুক্ত সমাজ গঠন, যেখানে অত্যাচার অবিচার জুলুম থাকবে না, দুর্নীতি থাকবে না।
১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের প্রথম পুলিশ সপ্তাহের ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, সব সরকারি কর্মচারীকেই আমি অনুরোধ করি, যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে, তাদের সেবা করুন। যাদের জন্য, যাদের অর্থে আজকে আমরা চলছি, তাদের যেন কষ্ট না হয়, তার দিকে খেয়াল রাখুন। তিনি বলেন, একটা নিরপরাধ লোকের ওপরও যেন অত্যাচার না হয়। তাতে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠবে।
১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আজ কে দুর্নীতিবাজ? যে ফাঁকি দেয় সে দুর্নীতিবাজ। যে ঘুষ খায় সে দুর্নীতিবাজ। যে স্মাগলিং করে সে দুর্নীতিবাজ। যারা কর্তব্য পালন করে না তারা দুর্নীতিবাজ। যারা বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করে তারাও দুর্নীতিবাজ। সরকারি আইন করে কোনোদিন দুর্নীতিবাজদের দমন করা সম্ভব নয় জনগণের সমর্থন ছাড়া। গণআন্দোলন করতে হবে। আমি গ্রামে গ্রামে নামব। এমন আন্দোলন করতে হবে, যে ঘুষখোর, যে দুর্নীতিবাজ, যে মুনাফাখোর, যে আমার জিনিস বিদেশ চোরাচালান দেয় তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে।
একই বছরের ২৫ জানুয়ারি সংসদে বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন, সরকারি কর্মচারী, মন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট আমরা জনগণের সেবক, আমরা জনগণের মাস্টার নই। তিনি আরও বলেন, যাদের পয়সায় আমাদের সংসার চলে, যাদের পয়সায় রাষ্ট্র চলে, যাদের পয়সায় পেট্রল খরচ করি, আমরা কার্পেট ব্যবহার করি, তাদের জন্য কী করলাম? সেটাই আজ বড় জিনিস।
টাঙ্গাইলের কাগমারীতে মাওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ উদ্বোধন করতে গিয়ে স্বাধীনতার মহান স্থপতি বলেন, বাংলাদেশের শতকরা ২৫ ভাগ দুঃখ দূর হয়ে যাবে যদি দুর্নীতি বন্ধ হয়ে যায়। দুঃখের সঙ্গে আমাকে বলতে হয়, আজকে আমরা অনেকে দুর্নীতিবাজ হয়ে গেছি।
স্বাধীনতার ৪৯ বছরে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের প্রশাসন কতটুকু বাস্তবায়ন হলো- এমন প্রশ্নে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ড. মো. মোজাম্মেল হক খান আমাদের সময়কে বলেন, সত্যিকারভাবে জাতির পিতার স্বপ্নে প্রশাসন এখনো গড়ে ওঠেনি। কিন্তু বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন, তাতে একদিন হয়তো বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে।
আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রশাসনে দুর্নীতি কমিয়ে সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। তবে কর্মচারীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু দুর্নীতিবিরোধী যেসব বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন সেসব বক্তৃতাকে মুজিববর্ষেই ‘চেতনা’ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। আর কালক্ষেপণ করা যাবে না। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের দেশ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়তে সরকারকে এখনই তার বক্তব্যগুলোকে ‘অঙ্গীকার’ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
একই বিষয়ে আমাদের সময়ের সঙ্গে কথা বলেছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ফয়েজ আহাম্মদ। তিনি বর্তমানে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য। ফয়েজ আহাম্মদ বলেন, ডিজিটাইজেশনের ফলে প্রশাসনে দুর্নীতি দিন দিন কমছে। দাপ্তরিক কাজগুলো যখন শতভাগ ডিজিটাল হবে তখন দুর্নীতি শূন্যের কোটায় নেমে আসবে। তবে দক্ষ ও জনবান্ধব প্রশাসন গড়তে নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হবে। তা হলেই এক সময় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের জনপ্রশাসন পাবে দেশের মানুষ।
বেতন-ভাতা বাড়ার পরও কর্মকর্তারা কেন দুর্নীতিতে জড়াচ্ছেন- এমন প্রশ্নে ফয়েজ আহাম্মদ বলেন, বিষয়টি সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। অনেক কর্মকর্তা এখন তার বেতন-ভাতার ওপরই সংসার চালান। তারা দুর্নীতিকে না বলতে পেরেছেন। তবে অনেক দরিদ্র কর্মচারী ছোটখাটো দুর্নীতি করেন। তাদের মিটিংয়ে সতর্ক করেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
Comment here