এখন কঠোর হচ্ছে সরকার - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

এখন কঠোর হচ্ছে সরকার

আরিফুজ্জামান মামুন : করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে যে ধরনের প্রস্তুতির সুপারিশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), বাংলাদেশে এসবের ঘাটতি রয়েছে। এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা। গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম ধরা পড়ে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত তিনজন। উচ্চঝুঁকি সত্ত্বেও আগে থেকেই কেন সরকার প্রয়োজনীয় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি, তা নিয়ে বিস্তর সমালোচনা রয়েছে বিভিন্ন মহলে। করোনার ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকতে যা যা করণীয়, সরকারের তরফে সে সব উদ্যোগ গ্রহণের ঘোষণা এলেও অনেক ক্ষেত্রে তা কার্যকর হয়নি, হচ্ছেও না। ফলে ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশটিতে ঝুঁকি কিন্তু রয়েই গেছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে নানাবিধ ব্যবস্থা নেওয়ার পরও নিশ্চিদ্র প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশে এখনো করোনা আক্রান্ত দেশগুলো থেকে হাজার হাজার মানুষ এসেছেন, আসছেন। বিদেশ ফেরত বাংলাদেশিদের কোয়ারেনটাইনে রাখার ক্ষেত্রে যতটা কঠোরতার প্রয়োজন ছিল, সেক্ষেত্রেও দেখা গেছে শৈথিল্য। দেশে গত ৮ মার্চ করোনায় আক্রান্ত তিনজনকে শনাক্ত করার পর পেরিয়ে গেছে আট দিন। এতদিন পর নড়েচড়ে বসতে শুরু করেছে সরকার। গতকাল মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে-বিদেশ থেকে যারা আসবেন, তাদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেনটাইনে থাকতে হবে; এর ব্যত্যয় হবে না। হলে জেল-জরিমানা করার কথা বলা হয়েছে।

ডব্লিউএইচও ইতিপূর্বেই করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকে ‘মহামারী’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। এ মহামারী ঠেকাতে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো; বন্ধ করে দিয়েছে আকাশ ও সড়কপথসহ সব ধরনের যোগাযোগ; সীমান্ত হয়ে প্রবেশ করে দিয়েছে নিষিদ্ধ। অথচ বাংলাদেশকে দেখা যায়নি দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিতে। সরকারের তরফে যুক্তরাজ্য ছাড়া ইউরোপের অন্য সব দেশের সঙ্গে গতকাল দুপুর ১২টা থেকে বিমান যোগাযোগ বন্ধ ঘোষণা করার পর গতকাল রাতেও ইউরোপের দেশগুলো থেকে এ দেশে প্রবেশ করেছেন অনেক মানুষ। আজও সৌদি আরবের জেদ্দা থেকে একটি ফ্লাইট আসার কথা রয়েছে।

গত রবিবার বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন অথরিটির (বেবিচক) তরফে বলা হয়েছিল, দেশের কিংবা বিদেশের, কোনো বিমান সংস্থাই ইউরোপের কোনো দেশ থেকে যাত্রী বহন করতে পারবে না। এর পরও গতকাল রাতে কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইট (কিউআর-৬৩৪)

রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এ ফ্লাইটে ইতালি থেকে ৬৮ আরোহী এবং জার্মানি থেকে ১৮ আরোহী ঢাকায় এসেছেন। এ ফ্লাইটের যাত্রীদের ফেরত পাঠানো হবে কিনা-এমন প্রশ্নে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মানবিক কারণে তাদের আসার অনুমতি দিয়েছে। শেষবারের মতো এ অনুমতি দেওয়া হয়।

তবে ইউরোপ থেকে যাত্রী আনায় কাতার এয়ারওয়েজের কাছে অসন্তোষ প্রকাশের বার্তা দিয়েছে বেবিচক। কর্তৃপক্ষ কাতারের সংশ্লিষ্ট অথরিটির কাছেও এ বিষয়ে একটি লিখিত অসন্তোষপত্র পাঠাবে। ওই ফ্লাইটে আসা ৯৬ আরোহীকে আশকোনায় কোয়ারেনটাইনে পাঠানো হবে-জানিয়েছেন বিমানবন্দরের স্বাস্থ্যবিষয়ক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহরিয়ার সাজ্জাদ।

তথ্যমতে, দেশে করোনা শনাক্তের পর গত ৮ দিনে ১ লাখ ৪ হাজার ৬৩ জন বিভিন্ন দেশ থেকে এ দেশে এসেছেন। শুধু গতকালই এসেছেন ১০ হাজার ৬৩ জন। তাদের ওপর যথার্থ নজরদারির ব্যবস্থাও করা হয়নি; দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এ ছাড়া দেশের সরকার করোনা বিষয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিলেও সাধারণ মানুষকে সেই অর্থে সচেতন করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং এ ভাইরাসটির বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা দিতে পারেনি। হোম কোয়ারেনটাইন অনেকেই উপেক্ষা করেছেন। সরকারের পক্ষেও কড়াকড়ি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ অবস্থায় করোনা ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বেড়েছে।

ঝুঁকি এড়াতে এখন থেকেই সব ধরনের আন্তর্জাতিক যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে পণ্য পরিবহনকারী জাহাজ ও কার্গো বিমানের যাতায়াত স্বাভাবিক রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। আঁতুড়ঘর চীনে করোনার প্রাদুর্ভাব কমে এলেও বেশকিছু দেশে এখনো ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে। স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন। গতকালও সর্বাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ইউরোপের দেশগুলোতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতিদিনই নতুন নতুন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে এ প্রাণঘাতী ভাইরাস। গতকাল পর্যন্ত ১৫৫টি দেশে ভাইরাস ছড়ানোর তথ্য পাওয়া গেছে। আক্রান্ত হয়েছে ১ লাখ ৬৪ হাজার ৯০১ জন। মারা গেছে ৬ হাজার ৫৭০ জন। ভয়ঙ্কর বিষয় হলো-ভাইরাসটির সংক্রমণের ধরন দেশভেদে ভিন্ন ভিন্ন।

করোনায় যে দেশ আক্রান্ত হয়েছে, সে দেশ তখনই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে সীমান্ত বন্ধ করেছে এবং শহরকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। ইউরোপকে করোনা ভাইরাসের প্রাণকেন্দ্র আখ্যা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থাটির প্রধান ড. টেডরোস আধানম ঘেব্রেয়েসাস সব দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রতিরোধে জোরালো পদক্ষেপ নিতে। স্কুল-কলেজ বন্ধের জন্য অভিভাবকদের পক্ষ থেকে জোরালো দাবি থাকলেও তাতে আগে সায় দেয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গতকাল শেষ পর্যন্ত ঘোষণা এসেছে-২ এপ্রিল পর্যন্ত সব স্কুল-কলেজ ও কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখার।

বিদেশ ফেরতরাই বড় ঝুঁকি : বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসে (কোভিড-১৯) আটজন শনাক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে চারজন বিদেশ ফেরত আর চারজন তাদের সংস্রবে আসা ব্যক্তি। পরিবারের সদস্যরা বিদেশ ফেরতদের মাধ্যমে কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, বিদেশ ফেরতরা এখন আমাদের জন্য ঝুঁকি। তারা দেশে না এলে এমনটি হতো না। ইতোমধ্যে যারা এসেছেন, সঠিক পদ্ধতিতে কোয়ারেনটাইনে থাকলেও ভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। আইইডিসিআরের সাবেক সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এম মুশতাক হোসেন বলেন, বিদেশ থেকে আসা বাংলাদেশিরা সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। তারা বিদেশ থেকে ভাইরাস বহন করে বাংলাদেশে ছড়াচ্ছেন।
বাংলাদেশ মেডিসিন সোসাইটির মহাসচিব ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেছেন, বিদেশ ফেরতরা বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস ছড়ানোর জন্য একমাত্র থ্রেট। তাদের মাধ্যমেই দেশে করোনা ভাইরাস ছড়াবে। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস ছিল না।

করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে নজরদারির প্রক্রিয়া আরও কঠোর করা হবে। কারণ প্রতিরোধের প্রথম ধাপই হচ্ছে রোগ নির্ণয়। রোগ নির্ণয় না করতে পারলে এর ভয়াবহতা আটকানো যাবে না। তিনটি বিষয়ে জোর দিতে শনাক্ত, পরীক্ষা ও চিকিৎসা-এই তিন নীতি নিয়ে এগোতে হবে।

বিমানের ওমান ফ্লাইটও বন্ধ

করোনা প্রতিরোধে ওমান সরকার আজ মঙ্গলবার থেকে তাদের দেশে বিদেশিদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ওমানের মাসকাটে বাংলাদেশ বিমান সপ্তাহে ১৪টি ফ্লাইট পরিচালনা করে। নিষেধাজ্ঞার পর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ওমানে তাদের সব ফ্লাইট স্থগিত করেছে।

বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোকাব্বির হোসেন বলেন, ওমানের সুপ্রিম কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৭ মার্চ মধ্যরাত থেকে সেদেশের নাগরিক ছাড়া কেউ সেখানে প্রবেশের অনুমতি পাবে না। এ কারণে বিমান মাসকাটে নিয়মিত ফ্লাইট বন্ধ করতে যাচ্ছে। এ কারণে চট্টগ্রাম থেকে মাসকাটগামী আজ রাত সাড়ে ৯টার বিমানের বিজি-১২১ ফ্লাইটটি সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় যাত্রা করবে।

বিমান ছাড়াও ওমান থেকে বাংলাদেশে সপ্তাহে সাতটি সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা করে সালাম এয়ার। করোনা ভাইরাসের কারণে এর আগে কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব, ভারত ও নেপাল তাদের দেশে বিদেশিদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়। ফলে বিমানও তাদের ফ্লাইট বন্ধের ঘোষণা দেয়। অন্যদিকে যুক্তরাজ্য ছাড়া ইউরোপের সব দেশের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ।

Comment here