নিজস্ব প্রতিবেদক : গ্রেপ্তার এড়িয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করে কীভাবে রিমান্ড থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, সেই ফন্দি আঁটছিলেন ভয়ঙ্কর প্রতারক মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম। তাই আত্মগোপনে থেকে দফায় দফায় আইনজীবীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ চলছিল। এমনকি একটি বিদেশি দূতাবাসে আশ্রয়েরও চেষ্টা করেছিলেন অর্ধশতাধিক মামলার এই আসামি। তবে কোনো পরিকল্পনাই শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে সাহেদ নিজেই চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য জানিয়েছেন। র্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের পর তিনি এখন ১০ দিনের রিমান্ডে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে আছেন। গতকাল শুক্রবার ছিল রিমান্ডের দ্বিতীয় দিন।
জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে যুক্ত গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, সাহেদের পরিকল্পনা ছিল কয়েক বছরের মধ্যে মন্ত্রী হওয়ার। তা বাস্তবায়ন করতেই টকশোর মাধ্যমে পরিচিতি বাড়ানোর চেষ্টা করছিলেন তিনি। পাশাপাশি ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করে নিজেকে দলের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে থাকা তার ছবিই এর প্রমাণ।
এদিকে প্রতারক সাহেদের কয়েক সহযোগীকে গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসছে তার প্রতারণার নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। গতকাল আরও দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানিয়েছে র্যাব।
গত বৃহস্পতিবার বিকালে ঢাকার আশুলিয়া থেকে গিয়াস উদ্দিন জালাল ও মাহমুদুল হাসানকে ৪৮টি চেকবইয়ের পাতা, রিজেন্ট গ্রুপের অফিসিয়াল সিল এবং সাহেদের ব্যবহৃত প্রাইভেটকারসহ গ্রেপ্তার করা হয়। ওই গাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ২ হাজার ১২০ পিস ইয়াবা এবং ১০ বোতল ফেনসিডিল। তাদের বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানায় র্যাব বাদী হয়ে মাদক আইনে মামলাও করেছে। র্যাব বলছে, উদ্ধার হওয়া প্রাইভেটকারটি সাহেদ করিম ব্যবহার করত। আর গ্রেপ্তার জালাল উদ্দিন রিজেন্ট গ্রুপের এমডি মাসুদ পারভেজের ভায়রাভাই।
সাহেদ করিম রিজেন্ট গ্রুপের নাম ব্যবহার করে অপকর্ম করেছেন বলে রিজেন্ট গ্রুপ লিমিটেডের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়েছে। এ নিয়ে ২০১৫ সালে রিজেন্ট গ্রুপ সাহেদকে লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছে বলেও দাবি করা হয়েছে। তারা বলছে, ক্ষমতাশালীদের কাছের মানুষ হওয়ার কারণে সাহেদ রিজেন্ট গ্রুপের নাম ব্যবহার করে নানা অপকর্ম করেছেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র বলছে, সাহেদকে গ্রেপ্তারের পর তার নানা অপকর্মের বিষয়ে অনেকেই স্বেচ্ছায় তথ্য দিচ্ছেন। আবার অনেকে এখনো সাহেদের ভয়ে মুখ খুলতে চাইছেন না। এ বিষয়ে র্যাব তাদের আইনি সহায়তা দিতে চায়। সাহেদের প্রতারণার বিষয়ে অভিযোগ দিতে বা আইনি সহায়তা পেতে ভুক্তভোগীদের র্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করা হয়েছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখা থেকে জানানো হয়েছে, প্রতারক সাহেদের বিষয়ে ভুক্তভোগীরা যে কোনো তথ্য দিতে বা আইনি সহায়তা পেতে র্যাব সদর দপ্তরের তদন্ত উইংয়ে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। হটলাইন- ০১৭৭৭৭২০২১১ এবং ই-মেইল: ৎধনযয়.রহাবংঃ@মসধরষ.পড়স।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ আমাদের সময়কে বলেন, সাহেদের দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলা হয়েছে। জালিয়াতির মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চাইলে তাদের শ্যোন এরেস্ট করতে পারেন।
সাহেদের বিরুদ্ধে র্যাবের করা মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, সাহেদের মামলাটি তদন্তভার আমাদের (র্যাব) দেওয়ার জন্য আবেদন করেছি। বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
সাহেদকে জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা জানান, সাহেদের প্রতারণার ক্ষেত্র কোনো একক বিষয়ে সীমাবদ্ধ ছিল না। নানা কৌশলে তিনি প্রতারণা করতেন। এসব প্রতারণা করতে তিনি নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে প্রমাণ করতেও নিয়েছেন প্রতারণার নানা কৌশল। রিজেন্ট হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা এবং করোনা রোগীদের সেবা নিয়ে প্রতারণার বিষয়টি সামনে চলে আসছে- এমন আভাস পেয়েই তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ধোঁকা দিতে নেন আরেক কৌশল। প্রথমে তিনি প্রচার করেন- তার হাসপাতালের নাম করে করোনার ভুয়া পরীক্ষা করছে প্রতারকচক্র। এটি প্রচারের পর তিনি পরিকল্পনা করছিলেন, রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েকজনকে ‘চাকরিচ্যুত’ করার।
এক্ষেত্রেও সবার চোখকে ফাঁকি দেওয়ার এক অভিনব কৌশল নেন। এই চাকরিচ্যুতির ঘটনাটি একটি নাটকের মতো হবে। যাদের চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে বলে প্রচার করা হবে, তাদের বেতন আরও ১০ হাজার টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হবে। তবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই র্যাব হাসপাতালে অভিযান চালায় এবং প্রতারণার বিষয়টি ফাঁস হয়ে যায়।
সাহেদকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন এমন এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, এই লোকটি নিজের বাবার সঙ্গেও প্রতারণা করেছেন। তারা কোভিড-১৯ পজিটিভ জানার পর অন্য একটি হাসপাতালে ভর্তির সময় সেই তথ্য গোপন করেছেন। আর নিজে পজিটিভ না হয়েও সবার সহানুভূতি পেতে পজিটিভ বলে ঘোষণা দেন। যে নমুনায় তিনি পজিটিভ হয়েছিলেন সেটি তার এক বিশ^স্ত কর্মীর নমুনা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাহেদ করিম জাল টাকার ব্যবসাও করতেন। তিনি বিভিন্ন ব্যক্তির পাওনা পরিশোধে জাল টাকা ব্যবহার করতেন। তার বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় এ সংক্রান্ত একটি মামলাও আছে। চাকরি দেওয়ার নাম করে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় অর্ধশতাধিক মামলা এবং অনেক মামলায় ওয়ারেন্টও ইস্যু হয়েছিল; কিন্তু তারপরও তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছেন। নানা কৌশলে প্রভাব বিস্তার করে এবং সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে তিনি অপকর্ম চালিয়ে গেছেন।
দুই সহযোগী গ্রেপ্তার : র্যাব জানায়, গত বৃহস্পতিবার রাতে আশুলিয়ার নরসিংহপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার হওয়া গিয়াস উদ্দিন জালালের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার রূপসাদী গ্রামে। গিয়াস রিজেন্ট গ্রুপের এমডি মাসুদ পারভেজের ভায়রাভাই। প্রাইভেটকারচালক মাহমুদুল হাসানের বাড়ি শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার ছোট কৃষ্টনগরে। করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা নিয়ে জালিয়াতি ও একাধিক প্রতারণার মামলায় এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে রিমান্ডে আছেন রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ করিম ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ পারভেজ।
রিজেন্ট গ্রুপ লিমিটেডের আপত্তি : প্রতারক সাহেদের মালিকানাধীন রিজেন্ট গ্রুপ ভুয়াÑ এমন একটি দাবি করে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়েছে। অ্যাডভোকেট জুয়েল রানা স্বাক্ষরিত ওই বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়েছেÑ তিনি প্রকৃত রিজেন্ট গ্রুপ লিমিটেডের পাবলিক রিলেশন অফিসার।
ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বহুল আলোচিত উত্তরা এবং মিরপুরের রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক প্রতারক সাহেদ করিমকে নিয়ে গত সপ্তাহজুড়ে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় ‘রিজেন্ট গ্রুপ’-এর নাম ব্যবহার করায় আমরা রিজেন্ট গ্রুপ লিমিটেড অত্যন্ত বিব্রত এবং অসম্মানবোধ করছি। রিজেন্ট গ্রুপ ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি কোম্পানি এবং অদ্যাবধি অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করে আসছে। রিজেন্ট গ্রুপ রেজিস্টার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ (আরজেএসসি) থেকে নিবন্ধন করা একটি কোম্পানি। রিজেন্ট গ্রুপের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান রিজেন্ট ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডও রেজিস্টার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি (আরজেএসসি) থেকে নিবন্ধন করা।
উল্লেখ্য, প্রতারক সাহেদ করিম রিজেন্ট গ্রুপের নাম ব্যবহার করে এবং অঙ্গপ্রতিষ্ঠান রিজেন্ট ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের নাম, তার ওয়েবসাইট এবং তার পার্সোনাল ফেসবুকে ব্যবহার করে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছেন। কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার মেরিন ড্রাইভ রোডের আমাদের রিজেন্ট গ্রুপের সাইনবোর্ড লাগানো ক্রয়কৃত জায়গার সামনেও ছবি তোলেন প্রতারক সাহেদ। পরবর্তী সময়ে প্রতারক সাহেদ তার পার্সোনাল ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে এই ছবি আপলোড করে প্রজেক্ট ভিজিট বলে প্রচার করেন। এর মাধ্যমে আমাদের সুনামের হানি হয়েছে এবং জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এর আগে রিজেন্ট গ্রুপের নাম ব্যবহার করার কারণে ২০১৫ সালে রেজিস্টার্ড ডাকযোগে আইন পরামর্শকের মাধ্যমে প্রতারক সাহেদের কোম্পানি বরাবর লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়। সেখানে তাকে রিজেন্ট গ্রুপের নাম ব্যবহার না করার জন্য বলা হয়। পাশাপাশি আমাদের কোম্পানির সুনাম ক্ষুণ্ন হওয়ায় ২০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণের মামলা করার কথাও উল্লেখ করা হয়; কিন্তু প্রতারক সাহেদ ক্ষমতাশালীদের কাছের মানুষ হওয়ায় আইনের তোয়াক্কা না করে রিজেন্ট গ্রুপের নাম ব্যবহার করে কুকর্মগুলো চালাতে থাকেন। ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে রিজেন্ট গ্রুপের নাম ব্যবহার করায় আমাদের ব্যবসার সুনামের ক্ষতি হচ্ছে, অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এবং জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে।
Comment here