জিয়াউল গনি সেলিম,রাজশাহী ব্যুরো : এক সময় উত্তরাঞ্চলের সংসদীয় আসনের বেশির ভাগই ছিল বিএনপির দখলে। সাংগঠনিক ভিত্তিও ছিল মজবুত। দাপুটে অনেক নেতাও ছিলেন এই অঞ্চলে। দলীয় কর্মসূচি মানেই ছিল নেতাকর্মীদের ঢল। কিন্তু নেতায় নেতায় বিভেদ, নেতৃত্ব বাছাইয়ে কেন্দ্রের ভুল সিদ্ধান্ত ও মামলা-হামলার কারণে সাংগঠনিক সে শক্তি আর নেই। রাজশাহী বিএনপি দিনে দিনে দুর্বল থেকে আরও দুর্বল হয়েছে। ‘চেইন অব কমান্ড’ বলতে কিছু নেই।
অন্তত তিন বছর ধরে রাজশাহী মহানগর ও জেলা বিএনপিতে এ দুরবস্থা চলছে। বর্তমানে যারা নেতৃত্বে আছেন তারাও বিভেদ ঠেলে সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। কোনো ইউনিটেই পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পারেননি। ফলে, সাংগঠনিকভাবে শক্তি সঞ্চয় করে চলমান আন্দোলন-সংগ্রামে কাক্সিক্ষত ভূমিকা রাখতে পারছে না রাজশাহী বিএনপি।
রাজশাহী বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতার কথা স্বীকার করেছেন দলের রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘যখন যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয় তারা আর ক্ষমতা ছাড়তে চায় না।’ জানা গেছে, দুই যুগের বেশি সময় রাজশাহী মহানগর বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু বলয়ের নিয়ন্ত্রণে ছিল। প্রথম দিকে তিনি নিজে সভাপতি ছিলেন। এরপর ২০১৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে সভাপতি ও শফিকুল হক মিলনকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। কিন্তু মিনুকে বাদ দেওয়ার পর থেকেই মূলত মহানগর বিএনপি দুর্বল হতে থাকে বলে মনে করেন স্থানীয় নেতারা। তারা বলেন, বুলবুল এবং মিলন প্রায় পাঁচ বছর দায়িত্বে থাকলেও তারা মহানগরের ওয়ার্ড-থানা কমিটি পুনর্গঠনে সফলতা দেখাতে পারেননি।
দলীয় সূত্রে, ২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর মহানগর বিএনপির নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিতে আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট এরশাদ আলী ঈশা ও সদস্যসচিব মামুনুর রশীদ মামুন। এর তিন মাস পর পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি দেওয়া হয়। তারাও পুনর্গঠনে সফলতা দেখাতে পারেননি। বরং ঈশা ও মামুনের এক রকম মুখ দেখাদেখি বন্ধ। তারা কর্মসূচিও পালন করেন পৃথকভাবে। দলীয় সূত্রে জানা যায়, গত ৭ নভেম্বর বিপ্লব ও সংহতি দিবসের কর্মসূচি ঈশা ও মামুন আলাদাভাবে পালন করেন। দুজনের দ্বন্দ্বের মাত্রা এতোই বেশি সদস্য সচিব মামুনুর রশীদকে অব্যাহতি দিতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে চিঠিও লিখেছেন। নেতাকর্মীরা আরও জানান, এ কমিটিও মহানগরীর কোনো ওয়ার্ড ও থানা কমিটি করতে পারেননি।
এ বিষয়ে রাজশাহী মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট এরশাদ আলী ঈশা বলেন, ‘আমাদের নিজেদের মধ্যে একজনের সঙ্গে আরেকজনের খানিকটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। সেগুলো কাটিয়ে উঠছি। কেন্দ্রই মিটিং করে এ সিদ্ধান্ত নিয়ে বলে দিয়েছে। সে অনুযায়ী কাজ হচ্ছে। আমরা থানা ওয়ার্ড কমিটি গঠনের প্রক্রিয়াও শুরু করেছি।’
এদিকে, ‘দাপুটে’ নেতা অ্যাডভোকেট নাদিম মোস্তফা জেলা বিএনপির সভাপতি ছিলেন। মিজানুর রহমান মিনুর মতো তাকেও জেলা থেকে সরিয়ে দেওয়া হলে মাঠ কাঁপানো এই নেতাও হারিয়ে যান। তার স্থলে তোফাজ্জল হোসেন তপুকে সভাপতি ও মতিউর রহমান মন্টুকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এই কমিটি ভেঙে দিয়ে ২০১৯ সালের ৫ জুলাই তিন মাসের জন্য আবু সাঈদ চাঁদকে আহ্বায়ক ও বিশ্বনাথ সরকারকে সদস্য সচিব করা হয়। প্রায় তিন বছরেও তারা ইউনিট কমিটি পুনর্গঠন কাজ শেষ করতে পারেননি।
রুহুল কুদ্দস তালুকদার দুলু বলেন, আহ্বায়ক কমিটির কাজ ছিল সম্মেলনের আয়োজন করা। কিন্তু মহানগর ও জেলা শাখা তা করতে পারেনি। নিজেরাই চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যস্ত কেন্দ্রীয় নেতারাও। তবে আসছে রমজানে মাঠের আন্দোলন কর্মসূচি কমে আসবে। সে সময় আমরা সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠনের চেষ্টা করব।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী জেলা বিএনপির অধীনে ইউনিট রয়েছে ২৩টি। এর মধ্যে ১৪টি পৌরসভা ও ৯টি উপজেলা। ২৩টি ইউনিটের মধ্যে গত তিন বছরে সাতটি ইউনিটের শুধু সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকের নাম ঘোষণা করে আংশিক কমিটি করা হয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি সম্মেলন করে ও একটি সম্মেলন ছাড়াই কমিটি ঘোষণা করা হয়। জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির সদস্য গোলাম মোস্তফা মামুন বলেন, করোনার জন্য দুই বছর সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালানো সম্ভব হয়নি। শিগগিরই বাকি ইউনিটগুলোর সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হবে।
তৃণমূলের নেতাকর্মী বলছেন, কমিটি গঠন নিয়ে দলের জেলা নেতৃত্ব আন্তরিক নয়। দলের তৃণমূলের প্রভাবশালী নেতাদের হস্তক্ষেপে এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের সৃষ্ট কোন্দলের কারণে কমিটি গঠন সম্ভব হচ্ছে না। এতে বিতর্ক তৈরি হচ্ছে। সঙ্গে বাড়ছে কোন্দলও।
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদ চাঁদের দাবি, দলের নেতাকর্মীরা এখন বেশ সংঘবদ্ধ। আগে তো জেলা সদরে কোনো কর্মসূচিই পালন হতো না। এখন নিয়মিতই হয়। আর দুই-একটি বাদ দিয়ে সব ইউনিটের কমিটি গঠন করা হয়েছে।
Comment here