একাত্তরে আওয়ামী লীগ - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
রাজনীতি

একাত্তরে আওয়ামী লীগ

রাজনৈতিক পথপরিক্রমায় প্রতিষ্ঠার ৭০ বছর পূর্ণ করে আজ ৭১তম বছরে পড়েছে আওয়ামী লীগ। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়াম অর্থাৎ জনগণের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে যাত্রা শুরু করে দলটি। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শামসুল হকের নেতৃত্বে যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে পথ চলতে শুরু করে জনগণের এই লীগ, তা আজ অনেকটাই বাস্তবায়নের পথে। পিছু ফিরে তাকালে দেখা যায়, ধারাবাহিক লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সাত দশকের যাত্রাশেষে আওয়ামী লীগ এখন এমন একটি অবস্থানে উত্তীর্ণ হয়েছে যে, বাংলাদেশের মানুষের অধিকার ও মুক্তির সমার্থকে পরিণত হয়েছে দলটি। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তারই সুযোগ্যা কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আজ দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল। টানা তিন মেয়াদে বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে দলটির নীতিনির্ধারকরা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্ষমতাসীন দল হওয়ার কারণে সাংগঠনিকভাবে কিছু সংকটও দেখা দিয়েছে দলটিতে। বিশ্লেষকদের মতে, সময়ের আবর্তে আওয়ামী লীগ একদিকে যেমন ‘প্রাজ্ঞ’ হয়েছে, অন্যদিকে তেমনই বিস্মৃতও হয়েছে সূচনালগ্নের অনেক স্বর্ণখচিত অধ্যায়। টানা তিন মেয়াদে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকায় আওয়ামী লীগ এখন সাংগঠনিকভাবে যথেষ্টই শক্তিশালী। কিন্তু বড় এক সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার মতো করে দলটাকে ভালোবাসেন হাতেগোনা গুটিকয় নেতাকর্মী। অধিকাংশই ব্যস্ত দলীয় নাম ভাঙিয়ে ব্যক্তিগত বিত্তবৈভব গড়ে তোলায়। এ কারণে দলীয় শৃঙ্খলা ধরে রাখাটাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তৃণমূল পর্যায়ে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রশ্রয়ে তাই ভিন্নমতাবলম্বীরাও আওয়ামী লীগে যোগ দিচ্ছেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। দলীয় নির্দেশ উপেক্ষা করে স্থানীয় নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে দল মনোনীত প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছেন দলেরই কেউ। নিজ বলয়ের নেতাকর্মীদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন আওয়ামী লীগেরই প্রভাবশালী নেতা, এমপি, এমনকি মন্ত্রীরাও। শুধু তা-ই নয়, সংগঠনের কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াচ্ছে অর্থের বল। আওয়ামী লীগ, দলটির সহযোগী ও ভাতৃপ্রতিম সংগঠনের কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ এখন সারাদেশেই কম বেশি উঠে আসছে। নির্বাচন কমিশনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সর্বশেষ পঞ্চম ধাপসহ এ পর্যন্ত ৪৪৫টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ৩২১ প্রার্থী নৌকা মার্কা নিয়ে এবং ১৪০ প্রার্থী বিদ্রোহ করে স্বতন্ত্র হিসেবে চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, ৭০ বছর পার করে আসা আওয়ামী লীগ এখন অনেকটাই বিকল্পহীন হয়ে গেছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। তা সত্ত্বেও দলটির মধ্যে সমস্যাও আছে, যেগুলোর অধিকাংশই দৃশ্যমান। কিছু আবার অভ্যন্তরীণ, ভেতর থেকে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দিয়ে দেখতে হবে। তিনি বলেন, একটি বড় দল অনেক দিন ক্ষমতায় থাকলে দলীয় শৃঙ্খলার যে সংকট হয়, সেটি আছে আওয়ামী লীগে। সে কারণে নির্বাচন এলেই প্রচুর সংখ্যক বিদ্রোহী প্রার্থীকেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেখা যায়। যদিও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের ভাষ্য, তাদের দলে কোনো সংকট নেই। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মাঠপর্যায়ে হয়তো কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি আছে। বিশেষ করে স্থানীয় নির্বাচনে যেখানে বিএনপি বা অন্যান্য দল অংশ নেয়নি, সেখানে নির্বাচনকে অংশগ্রহনমূলক করতে আওয়ামী লীগেরই একাধিক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। সে কারণে হয়তো কিছু এলাকায় ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে, এটা আওয়ামী লীগের কোন্দল নয়। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের তৃণমূল সব সময় ঐক্যবদ্ধ, সব সময় নেতৃত্বের প্রতি আস্থাবান। বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগ দেশের শুধু প্রাচীন ও সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলই নয়, বাংলাদেশের রাজনীতির মূল ধারাও। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ইতিহাস একই সূত্রে গাঁথা। বায়ান্নর মাতৃভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ১৯৬২ ও ১৯৬৪ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ৬ দফা, ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৬ দফাভিত্তিক ১৯৭০-এর নির্বাচনসহ বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সব আন্দোলন সংগ্রামে আওয়ামী লীগের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে দলটির ভূমিকা সর্বজনস্বীকৃত। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় ঐক্য গড়তেও আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে। স্বাধীন দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার ব্যস্ত, তখন ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এর পর আওয়ামী লীগের ওপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়্গ। নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে যান দলটির নেতাকর্মীরা; বৃত্তবন্দি হতে থাকে আওয়ামী লীগ। দলের এহেন দুঃসময়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসেন। আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দলের হাল ধরেন। তার নেতৃত্বে পুনরুজ্জীবিত হয় আওয়ামী লীগ। সেই থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ৩৮ বছর ধরে শক্তভাবে দলের হাল ধরে রেখেছেন শেখ হাসিনা। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ৭০ বছরের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় আন্দোলনের সংগ্রামের বাঁকে বাঁকে আওয়ামী লীগ নানা ত্যাগ-তিতিক্ষা-পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছে। সারা পৃথিবীতে এমন রাজনৈতিক দল কমই আছে, যে দলের নেতৃত্বে একটা নিরস্ত্র জাতি সশস্ত্র সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশ স্বাধীন করেছে। তিনি বলেন, নানা সময়ে নানা কারণে বিভিন্ন সংকট মেরুকরণ হয়ে থাকতে পারে; কিন্তু আজকে আওয়ামী লীগে কোনো অভ্যন্তরীণ সংকট আমরা দেখি না।

কারণ আওয়ামী লীগ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সমন্বয়ে একটি আদর্শভিত্তিক দল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এখন সুসংগঠিত। ইস্পাতকঠিন ঐক্য আওয়ামী লীগে। এর পরও সাম্প্রতিককালে আওয়ামী লীগ তার আদর্শ ও ঘোষণাপত্রের মূল লক্ষ্য থেকে থেকে একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে কিনাÑ এমন প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। ১৯৪৯ সালে রোজগার্ডেনে সম্মেলনের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করা আওয়ামী লীগ মাত্র ৬ বছরের মাথায় মুসলিম শব্দটি ছেঁটে ফেলে। ১৯৫৫ সালের কাউন্সিলে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসেবে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’ নামে যাত্রা শুরু করে। সম্প্রতি হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক; কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষার মানে উন্নীতকরণসহ এমন কিছু বিষয় আওয়ামী লীগের সরকারের সময়ে হওয়ায় অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন দলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে। ইতিহাসের শিক্ষক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের মতে, ভোটের রাজনীতি ও বাস্তব পরিস্থিতির কারণে আওয়ামী লীগের যে আদর্শিক বিচ্যুতি ঘটেছে, এটা বড় একটা সংকট। কারণ আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবেই যাত্রা শুরু করেছে ১৯৫৫ সালের ২২ অক্টোবর থেকে। বঙ্গবন্ধু একটি অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবেই আওয়ামী লীগকে গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু ২০১১ সালে যে ১৫তম সংশোধনী হলো সংবিধানের, তাতে ধর্মনিরপেক্ষতাও যেমন আছে, তার পাশাপাশি রাষ্ট্রধর্মও রয়েছে। এটা হিসাবে মিলছে না। রাষ্ট্রধর্ম যদি কোনো রাষ্ট্রে থাকে, তা হলে সেই রাষ্ট্র অনিবার্যভাবে ধর্মভিত্তিক হয়ে যায়। পাশাপাশি অত্যন্ত সাম্প্রদায়িক, নারীবিদ্বেষী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সখ্য নানাবিধ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কওমী মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসকে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের সমমান করা হলো সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। তিনি বলেন, মনে রাখতে হবে আওয়ামী লীগের কাছে মানুষের প্রত্যাশা বেশি, সে জন্য দলটির ব্যত্যয় বিচ্যুতি নিয়েও নানারকম প্রশ্নের জন্ম হয়। তবে ড. আনোয়ারের এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতিম-লীর সাবেক সদস্য এবং গবেষক নূহ উল আলম লেনিন। তিনি আমাদের সময়ের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, আওয়ামী লীগ কখনো তার লক্ষ্য ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়নি। রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হয় একটি দলকে। তার মানে এই নয় যে, এটা আদর্শবিচ্যুতি। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বিষয়ে তিনি বলেন, ইংল্যান্ডেও রাষ্ট্রধর্ম প্রোটেস্ট্যান্ট ক্রিশ্চিয়ান। কিন্তু ইংল্যান্ডকে কেউ মৌলবাদী রাষ্ট্র বলে না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলেও এখানে সব ধর্মের মানুষ সমানভাবে ধর্মীয় স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারে। ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবারÑ এই নীতিতেই চলছে বাংলাদেশ। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগই আবার অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে পুনর্প্রতিষ্ঠা করেছে বলেও দাবি করেন তিনি।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও নৌপরিরহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, যে স্বপ্ন নিয়ে বঙ্গবন্ধু দেশটাকে স্বাধীন করেছিলেন, সেই স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে জননেত্রী শেখ হাসিনা কাজ করে যাচ্ছেন। একটি অনুন্নত দেশ ইতোমধ্যে উন্নয়নশীল দেশ হয়েছে। বাংলাদেশকে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তোলাই এখন আওয়ামী লীগের লক্ষ্য। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, বাংলাদেশের জনগণ এখন বিশ্বাস করে, নির্ধারিত সময়ের আগেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।

Comment here