কোভিড-১৯ চিকিৎসায় কতটুকু এগোলাম - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
আন্তর্জাতিক

কোভিড-১৯ চিকিৎসায় কতটুকু এগোলাম

ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান : সারাবিশ্বে করোনা ভাইরাস এবং এই ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট কোভিড-১৯ রোগটি আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রতিদিনই বেড়ে চলছে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। ক্ষুদ্র এই ভাইরাসের সঙ্গে মানবসভ্যতার এই উৎকর্ষের সময়েও চলছে এক অসম যুদ্ধ এবং প্রমাণ করেছে আমরা কত অসহায়। তবে থেমে নেই চিকিৎসা বিজ্ঞান ও গবেষকরা। তারা সর্বোচ্চ মেধা ও প্রচেষ্টা নিবেদন করেছে এই ভাইরাসটির বিরুদ্ধে প্রতিষেধক ভ্যাকসিন এবং এই রোগটির চিকিৎসার ওষুধ আবিষ্কার করার জন্য। অনেক ক্ষেত্রেই কিছুটা সফলতার সম্ভাবনা দেখা দিলেও উপসংহারে আসার সময় এখনো আসেনি। এখন পর্যন্ত এই রোগের চিকিৎসার যে অগ্রগতি সেটি নিয়েই আজকের আলোচনা।

ভ্যাকসিন নিয়ে যত কথা

সারাবিশ্বের সব বড় বড় সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করার জন্য। কিন্তু মনে রাখতে হবে কোনো ভ্যাকসিন তৈরি করা এবং এটিকে প্রায়োগিক পর্যায়ে আনা একটি দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল প্রক্রিয়া। ভ্যাকসিন তৈরির মূল কথা হচ্ছে-ভাইরাস বা ব্যকটেরিয়া বা যে কোনো জীবাণুকে দুর্বল করে অথবা এই জীবাণুর কিছু অংশ শরীরে প্রয়োগ করা। ফলে জীবাণু রোগ তৈরি করতে পারে না; কিন্তু আমাদের শরীর এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। তবে কোন মাত্রায় জীবাণুর কোন অংশ কীভাবে প্রয়োগ করা যায়, সেটি রোগ সৃষ্টি না করে শরীরে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে-সেটিই গবেষণা করে নির্ধারণ করতে হয়।

এ জন্য প্রথমেই প্রয়োজন জীবাণুটির সম্পূর্ণ জেনেটিক মানচিত্র চিহ্নিত করা, কম্পিউটারের মাধ্যমে সম্ভাব্য মলিকিউল নকশা করা, যেটি এন্টিজেন হিসেবে কাজ করবে সেই অংশটিকে আলাদাভাবে তৈরি করা, পরিশোধন করা এবং প্রাণীদেহে এর কার্যকারিতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যে, চীনের বিজ্ঞানীরা অতিদ্রুত ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথমেই করোনা ভাইরাসের জিনগত বিন্যাসের মানচিত্র চিহ্নিত করেছেন, যা ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের কাজটি ত্বরান্বিত করেছে।

গবেষণাধীন ভ্যাকসিনটির কার্যকরিতা এর পর প্রাণীদেহে এবং এর পরবর্তী সময়ে সুস্থ মানবদেহে (স্বপ্রণোদিত) প্রয়োগ করা হয়। সুস্থ মানবদেহে ওষুধের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করে সীমিত পরিসরে আরও চার পর্যায়ে প্রয়োগ করা হয়। সবশেষে কার্যকারিতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বিবেচনা করে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার অনুমোদন সাপেক্ষে ভ্যাকসিনটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে আসতে পারে। ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পর এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে কমপক্ষে দুই বছর সময় লাগে। তবে আশার কথা হচ্ছে-অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের বর্তমান অগ্রগতি

বর্তমানে ৩৫ প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা পৃথিবীব্যাপী কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন তৈরিতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছে। অনেকেই নিশ্চয়ই জানেন যে যুক্তরাষ্ট্রে একটি প্রতিষ্ঠান (ইরড়ঃবপয ঈড়সঢ়ধহু গঙউঊজঘঅ–ঝবধঃঃষব, ডধংযরহমঃড়হ) ইতোমধ্যে এই ভ্যাকসিনটি সুস্থ স্বপ্রণোদিত ব্যক্তির ওপর প্রয়োগ করেছে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং অন্যান্য দেশের বৃহৎ সংস্থা আরও প্রায় চার ধরনের ভ্যাকসিন প্রাণীদেহে প্রয়োগের পর্যায়ে গবেষণারত রয়েছে।

কোভিড ১৯-এর ওষুধের বর্তমান অবস্থা

করোনা ভাইরাস একটি আরএনএ ভাইরাস। অন্যান্য যে কোনো ভাইরাসজনিত রোগের মতোই এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট ওষুধ উদ্ভাবন ও প্রয়োগ একটি কঠিন প্রক্রিয়া। এর একটি প্রধান কারণ এই ভাইরাস তার জিনগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে। তাই সঠিক এবং নির্দিষ্ট ওষুধ এখনো নির্ধারিত হয়নি। তবে একাধিক ওষুধ প্রয়োগ করে বেশ আশানুরূপ ফল পাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ভ্যাকসিন আবিষ্কারের মতোই কোনো রোগের সুনির্দিষ্ট ওষুধ আবিষ্কার একটি দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল প্রক্রিয়া।

বিশ্বব্যাপী মহামারীর এই জরুরি অবস্থায় বিজ্ঞানীরা নতুন ওষুধ আবিষ্কারের দীর্ঘ পথের পরিবর্তে ইতোমধ্যে বিভিন্ন রোগে ব্যবহৃত সম্ভাব্য ওষুধ, যা করোনা ভাইরাসে কার্যকর হতে পারে সেগুলো প্রয়োগ করে চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে কোনো ওষুধের কার্যকারিতা নির্ধারণের জন্য বিজ্ঞানসম্মত তথ্য ও উপাত্তের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ব্যাপক গবেষণা ও ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল প্রয়োজন।

অতি সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা সলিডারিটি ট্রেইল নামের একটি মেগাট্রায়ালের ঘোষণা দিয়েছে, যার মাধ্যমে বর্তমানে অন্য রোগের জন্য প্রচলিত কিছু ওষুধ কোভিড ১৯-এর বিরুদ্ধে কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করা হবে। এই রকম অভূতপূর্ব সমন্বিত উদ্যোগ আগে খুব কম দেখা গেছে, যার মাধ্যামে সারা পৃথিবীর বহু দেশের হাজার হাজার রোগীর বৈজ্ঞানিক তথ্য আহরন ও বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ করা হবে।

গবেষণাধীন সম্ভাব্য ওষুধসমূহ

ফেভাপিরাভির : বর্তমানে এই ওষুধটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। জাপানি ডাক্তারদের প্রস্তাবিত এই ওষুধটি ভাইরাস নির্মূল ও উপসর্গ কমানোর ক্ষেত্রে একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছে। ওষুধটি অন্যান্য ভাইরাস ইনফেকশন যেমন- ইবোলা ভাইরাস, ফ্লু ভাইরাস ইত্যাদিতে আগেই ব্যবহৃত হয়েছে। আশার কথা এই যে, এই ওষুধটি বাংলাদেশের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদন করতে সক্ষম। তবে ওষুধটি এখনো কোভিড ১৯-এ ব্যবহারের জন্য অনুমোদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো অনুমোদন করেনি।

রেমডেসিভির : এই ওষুধটি ইবোলা মহামারীর জন্য সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড-১৯ আক্রান্ত মারাত্মক অসুস্থ রোগীদের প্রয়োগ করার পর আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়। কিন্তু ওষুধটি শিরাপথে ব্যবহৃত এবং ব্যাপক ব্যয়বহুল বিধায় এর ব্যবহার সীমিত পর্যায়ে সম্ভব।

রিটোনাভির/ লোপিনাভির (কালেট্রা/আলুভিয়া) : এই ওষুধটি এইচআইভি এইডসের জন্য আগে থেকে ব্যবহৃত হতো। এই ওষুধটিও পরীক্ষামূলকভাবে কোভিড ১৯ রোগীদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হলেও ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের উপযোগিতা প্রমাণিত হয়নি।

ক্লোরোকুইন : এই ওষুধটি ম্যালেরিয়ার ওষুধ হিসেবে আমাদের দেশে ব্যাপক পরিচিত। ক্লোরোকুইন এবং এই ওষুধের সামান্য পরিবর্তিত রূপ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ব্যবহারের পর কোভিড-১৯ রোগীদের হাসপাতালে অবস্থানের সময় এবং রোগের উপসর্গ উভয়ই হ্রাস পেয়েছে। বলা হয় ওষুধটি ফুসফুসের কোষের অভ্যন্তরীণ পরিবেশে এমনভাবে পরিবর্তন করে যে, ভাইরাসটি কোষের ভেতর বাঁচতে ব্যর্থ হয়।

ক্লোরোকুইন ও অ্যাজিথ্রোমাইসিন : ক্লোরোকুইন ও একটি বহুল প্রচলিত এ্যান্টিবায়োটিক অ্যাজিথ্রোমাইসিনের সমন্বয় কোভিড ১৯-এর চিকিৎসায় বেশ সুবিধা পাওয়া গেছে। আশার কথা হচ্ছে-এই ওষুধগুলো বাংলাদেশে উৎপাদিত হয় এবং দেশে পাওয়া যায়।

আইভারমেকটিন : আশির দশক থেকে এই ওষুধটি মাথার উকুন ও স্কাবিস নামক চর্মরোগে বহুলভাবে ব্যবহৃত । গবেষকরা কোভিড-১৯ রোগে এই ওষুধটি ব্যবহারে আশাব্যঞ্জক ফল পেয়েছেন-যদিও তা ল্যাবরেটরি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ।

কনভালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি

সাম্প্রতিক সময়ে কোভিড-১৯ রোগ থেকে সেরে ওঠা রোগীদের রক্ত হতে আলাদা করা রোগ প্রতিরোধক উপাদান যুক্ত প্লাজমা জটিল ও মুমূর্ষু কোভিড ১৯ রোগীদের দেহে প্রয়োগ করে সুফল পাওয়া গেছে। ইউ এসএফডিএ এই চিকিৎসা পদ্ধতি অনুমোদন দিয়েছেন। এর আগে সারস, মারস ও অন্যান্য করোনা ভাইরাস সংক্রমণের এই পদ্ধতি প্রয়োগে সাফল্য পাওয়া গেছে। মুমূর্ষু কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পারে।

শেষ কথা

কোভিড-১৯ একটি বৈশ্বিক মহামারী। এই ক্ষুদ্র জীবাণুর বিরুদ্ধে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে যুদ্ধ করে চলেছে সমগ্র বিশ্ব। মানবজাতি দীর্ঘদিনে পুঞ্জিভূত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়েই এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। আমাদের বিজ্ঞানী, গবেষক ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা অবশ্যই পারব এই রোগের সঠিক চিকিৎসার রূপরেখা চূড়ান্ত করতে। আশা করা যায় অতিদ্রুতই আমরা এই সমস্যার সমাধানে পৌঁছাতে পারব।

অধ্যাপক, বক্ষব্যাধি মেডিসিন বিভাগ, বিএসএমএমইউ

Comment here